অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
মেঘলা আকাশ - প্রদীপ দে

মি আর আকাশ আজ চুটিয়ে রঙ খেললাম ওদের ছাদে। কালো বেগুনী রঙ যে তেল দিয়ে মাখালে এত বিভৎস দেখতে লাগে -আগে আমি কোনদিন দেখিনি। আকাশকে চেনাই যাচ্ছিল না। ওকে নিয়ে আমি মজা করে হেসে উঠেছিলাম -- হো হো -- দ্যাখ এবার কেমন লাগে?
     আকাশ তাড়াতাড়ি করে মোবাইলে ওর মুখটা দেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল। আর আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে মজা উপভোগ করছিলাম, হাসিটা দেখিয়ে, আবার লুকিয়ে।
     আচমকা আমি এক নারী কন্ঠে হা --হা শব্দে অনাবিল এক ব্যাঙ্গার্তক হাসির আওয়াজে চমকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক কিশোরী চকিতে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। এক চকিতে সে আমার কাছে তার নীল পরিধানে এক অপরুপা লাস্যময়ী হয়ে ধরা পড়েও হারিয়ে গেল।
     আকাশ ততোক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তরুনীর হাসি তাকে উদ্দেশ্য করেই এটা সে বুঝে ফেলেছে। কিন্তু কিছু করার নেই দেখে মানে মানে সেই যাত্রায় তার হার মেনে নিয়েছে।
     আমি আর থাকতে পারলাম না - কে রে ওই ফাজিলটা?  
     -ও মেঘা, মানে মেঘলা।
     -তা এমন করে হাসলো কেন? তোকে কি ভালোবাসে?
     -না, ও আমায় বাসে না। আমি বাসি।
     আমি একটা ধাক্কা খেয়ে চুপ করে গেলাম। কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ক্ষেত্রে কি উত্তর হওয়া উচিৎ তাই ভাবছিলাম। হঠাৎই কেন জানিনা মনের কোণে যেন সূর্য দেব একটু উঁকি দিয়ে গেল। কিশোরীর লাস্যময়ী হাসিমাখা মুখ আমার হৃদয়ের কোমল পদ্মে যেন এক মধুর রাগিণী হয়ে গুমরিয়ে উঠলো। মাথায় দুষ্টুমি খেলা করলো।
     -চল চল, অনেকে হয়েছে, এবার বাড়ি যাই।  বলেই তড়তড়িয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে এলাম।
     খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নেওয়া আর হলো না। ওই নীলাম্বরী আমাকে যেন বারবার ডাকছিলো। বিকালের আগেই বেড়িয়ে পড়লাম- সে কিশোর বয়সে, অন্য এক কিশোরীর খোঁজে। 
     মাথায় কথাটা ঘুরছিল- ও আমায় বাসে না। তাহলে কাজটা খুবই সহজ হবে। হয়তো বিধাতা ওকে আমার জন্যই বানিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে আকাশের পাশের বাড়ির আশে পাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। যদি একবার তার দেখা পাই। আর তো তর সইছে না। একঘন্টা ঘুরে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছি- এমনই সময় দরাম করে দোতলার জানালা খুলে গেল। আমি চকিতে মাথা তুলে দেখি আমার চাওয়া- মেঘ--।
     তখন আর মাথার ঠিক রাখতে পারলাম না। ইশারায় ওকে ডাকলাম। অবাক কান্ড! ও আমাকে ওর সুন্দর টানা চোখ দিয়ে ইশারা করলো যেন- দাঁড়াও--।
     পাশের সরু গলির মধ্যে চলে গেলাম। মেঘলা ওই নীল লম্বা জামাটা পড়েই খালি পায়ে চলে এল- কি তাড়াতাড়ি বলো?
     ওর চোখের চাওনিতে এক নেশা মাখানো আগুন। আমি জানতে চাইলাম- তুমি কি আকাশকে---?
     কথা শেষ করতে দিল না। চোখ নামিয়ে নিল। -অন্য কিছু বলবে?
     আমি বুঝে গেলাম। সব জানা হয়ে গেছে। আমি তো এটাই চাইছিলাম। আকাশকে আমারও ভাল লাগে না। মেঘলাকে আমার চাই।
     -আমি তোমায় কি বলবো--- আমতা আমতা করছি।
     নীলাম্বরী মেঘ মুক্তোর দাঁতে হাসলো- বাব্বা! এত কষ্ট?
     লাজ-লজ্জার গুলি মেরে আমি বলে ফেললাম- আমি যদি ভালোবাসি?
     -যদি?  -- বলেই হি-হি করে তার কি হাসি!
     আমি সাহস পেয়ে গেলাম। বুঝলাম মেঘলা খুব সাহসী।  আমি সত্যি কত বোকা। মেয়েরা কি ছেলেদের থেকে বেশী সাহসী হয়?  
     এইসব ভাবছি। দেখলাম মেঘ আমার কাছে চলে এসেছে। আমি দুহাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলাম। ওর ওষ্ঠ কাঁপছে। আমারও।  এত সহজে ওকে পাবো ভাবিনি। ও বোধহয় আগে থেকেই আমাকেই চেয়েছিল। আকাশকে আমার জন্যই কায়দা করছিলো। আমি খুব খুশি। আকাশ মরুক। ও আমার শুধু বন্ধু, আর মেঘ আমার জীবন। আমরা দুজনে দুজনের খুব কাছে- দুহাতের নাগালে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। সরু গলিটা নির্জন। হঠাৎ মাথার পিছনে বিরাট কিছুর প্রহারে আমি কাতরে উঠলাম। এক বেগুনে রঙের শয়তান যেন দ্রুত গতিতে সর গেল। কিছু বোঝার আগেই চোখে অন্ধকার দেখে ধপাস করে পড়ে গেলাম।
     এরপর একমাস পরে হসপিটাল থেকে বাড়ি এলাম। বাবা মা কি বুঝেছিলো জানিনা। বাড়িতে  আসার পর বিছানায় ছিলাম। একদিন মা জানালো আকাশ দেখতে আসছে। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। চোখ কচলে দেখলাম আকাশ ঘরে ঢুকলো সঙ্গে মেঘ। মেঘলার সিঁথি লাল। 
     মা জানালো- তুই যখন হসপিটালে তখনই ওদের বাবা মা ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আকাশ নাকি তোর ফেরার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ওদের পরিবার তাড়াতাড়ি করে ওদের বিয়েটা দিয়ে দেয়।
     আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম অন্ধকারে আকাশ মেঘলা! 

প্রদীপ দে। কোলকাতা