স্থবির সময়ে - সাইফুল ভুঁইয়া
আমাদের এই বসুমতীর সৌরবক্ষে পরিক্রমণের সাথে সাথে সময়ও থেমে থাকে না, আবর্তিত হয় নিরন্তর। আর এটাই হচ্ছে শ্বাশত নিয়ম। তবে সব নিয়মেরই একটা ব্যতিক্রম থাকে এবং সে রকমই একটি ব্যতিক্রমী সময় ছিল গেল শনিবার রাত।
টুক টুক টুক – রাত তখন একটা ঊনষাট। শাহীন ঠায় দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছে কম্পিউটারের দিকে। বহমান সময় কিভাবে ত্রিমাত্রিক চক্রে বন্দী হয় তা স্বচক্ষে দেখার জন্যই এই ব্যকুলতা তাঁর।
সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে গেল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা – টুক করে সময়ের কাঁটা রাত দুইটায় না গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবার রাত একটায়। এক মহা আনন্দের ব্যপার – মনে হয় অধো:গামী এক টাইম মেশিনে করে বর্তমান থেকে আবার অতীতে পাড়ি জমানোর মতোই এক ব্যাপার এটি। তবে ও হয়তো মনে মনে ভাবছে কী মজাই না হতো যদি এভাবে যুগ যুগান্তর পাড়ি দিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষদের জীবনধারা এক পলক দেখে আসা যেত। দেখে আসা যেত দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানীর প্রেম কাহিনি। সেই আদিম যুগে কি পরকীয়া বলতে কিছু ছিল?
ইদানিং শোনা যায় কতো ঘরই না ভাঙ্গছে এই ফেসবুক পরকীয়ার জন্যে। আমাদের এক জামাল ভাইতো পরকীয়াকে আচারের মতো বলতে বলতে শেষটায় নিজেই ফেঁসে গেলেন এক কন্টক বন্ধনে। সকল অতীত বন্ধন ছিন্ন করে নতুন এক অনাকাঙ্খিত জীবনের পরিব্রাজক তিনি এখন।
গতকাল রাতের কথা।
আমরা খাবার দাবার শেষে ফ্যামিলি রুমে বসে গল্প করছি।
আর এই সময়ে ফোন এবং তাও বাংলাদেশ থেকে। একটু ভয় পেলাম এই ভেবে যে এতো রাতে কোন দুঃসংবাদ না-তো। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার বাবার ফোন নাম্বার থেকে ফোন। সেকেন্ডেই মাথা একটা চক্কর দিল, সারা শরীরে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করলাম। ভাবলাম বয়স্ক মানুষতো আর এতো রাত জেগে থাকবেন না। তবে তাহলে এই নম্বর থেকে ফোন আসবে কেন? তাহলে কি কোন অঘটন এবং এটা জানানোর জন্যই কি ওনার মোবাইল থেকে আমার সেভ করা নম্বরে ফোন?
আমার বাবার বয়স পঁচাশি ছাড়িয়েছে এরই মধ্যে। তাই মনের ভিতর একটা অজানা ভয় কাজ করে সব সময়, বিশেষ করে অসময়ে দেশ থেকে ফোন এলে। কিন্তু না আমাকে স্তম্ভিত করে আমার বাবাই কথা বলতে শুরু করেছেন। যদিও উনি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন না ভালো। ইদানিং ওনার কানেও সমস্যা হচ্ছে, বয়স হলে যা হয়- একটা সারালে অন্যটা। যদিও কথা বার্তায় উনি বোঝাতে চান উনি খুবই ভালো আছেন। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন মসজিদে গিয়ে। চারতলায় ওঠা নামা করেন অন্ততঃ পাঁচ ওয়াক্তে দশ বার। তাই হিসেবে একটি মুরগীর বয়সও হয় নাই ওনার। যাই হোক শেষটায় বুঝিয়ে বললাম আপনি ফোনটা আম্মাকে ধরতে বলেন –আমি ফোন করছি আবার।
আম্মা বরাবরের মতোই জানতে চাইলেন আমাদের উইন্ডসরে এখন কয়টা বাজে? আমি সময় বললাম। তবে যতবারই বলি সময়ে আমরা পেছানো দশ ঘন্টা সেটা কখনই মাথায় নেবেন না উনি। এই সময় ব্যবধান মার্চ থেকে অক্টোবর দশ ঘন্টা আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী এগার ঘন্টা। অবশ্য এটা আমার সত্তরোর্ধ মা কেন দেশে থাকা প্রায় সবাই করে থাকেন। তবে এটা সত্য যে ডে-লাইট সেভিংস টাইমের কনসেপ্ট হয়তো আমাদের এই তুষার রাজ্যের জন্যই ভালো কাজ করে। বাংলাদেশের জন্য হয়তো এটা প্রযোজ্য না, তা যতো ভালই হোক। এই কনসেপ্ট বোঝানো যতটা না কঠিন, প্রয়োগ করা হয়ত বেশি কঠিন।
আমার আম্মা আজ খুব শান্ত এবং পরিস্কার গলায় কথা বলছেন।
বললেন আমরা জানি যে রাতে ফোন দিলে তোমাদের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে। এজন্য তোমাদের এখানে বেশি রাত হলে হয়ত ফোন দিতাম না। কিন্তু এখন তোমাদের ভর দুপুর তাছাড়া আজ তোমাদের ছুটির দিন তাই ফোন দিলাম। তোমার চাচা খোরশেদ এসেছেন সিলেট থেকে – আমরা সবাই মিলে গল্প করছি অনেক রাত অবদি আর তোমাদের স্মরণ করছি। ভাবলাম মা বাবা বলেই হয়তো এটা সম্ভব। এই বয়সেও ছেলের ঘুমের অসুবিধার কথা চিন্তা করেন- চিন্তা করেন সময় অসময়ের কথা।
সময় গতিশীল, সময় অবিনশ্বর।
বহমান কালচক্রের রূপালী ফিতায় আমরা আবর্তিত হচ্ছি নিরন্তর। থেমে নেই কিছুই, শুধু রয়ে যায় স্মৃতি- কিছু ভালো লাগার, কিছু বেদনার।
এমনি এক হেমন্ত দিনের কথা।
তখনও ঢাকা কুমিল্লা যাতায়াত এত কঠিন ছিল না। আমি ঢাকা থেকে কর্মব্যস্ত দিন শেষ করে কুমিল্লায় আসছি। পরদিন ঈদ তাই নন-স্টপ বাসেও তিল ধারনের জায়গা নেই। আমার ভাগ্য ভালো জনৈক বাসের হেল্পার আমাকে নিতে রাজি হলেন – শর্ত ড্রাইভারের পেছনটায় যে ইঞ্জিন তাঁর উপর পাতানো সিটে বসতে হবে। আমি তাতেই রাজি হলাম সানন্দে, ভাবলাম তাও সাত কপালের ভাগ্য – যে পেয়েছি একটা সিট। বিরামহীন গাড়ী চলছে উল্কা বেগে, বাজছে হেমন্তের গান “এই পথ যদি না শেষ হয় – তবে কেমন হতো বলতো ”।
সময়ের কাঁটা ঘুরছে অবিরত – সাথে চলছি আমরাও। কিন্তু আমি বসে থাকতে পারছিলাম না আমার জায়গায়। একে তো সিটের নিচে ইঞ্জিনের উত্তাপ আর তার সাথে যোগ হয়েছে পাশের যাত্রীর তন্দ্রাচ্ছলে আমার উপর হেলে পড়া। সব মিলে আমাকে উঠতেই হলো সিট থেকে। গিয়ে দাঁড়ালাম পিছনের সিটের যাত্রীর পাশে। কিন্তু বিধি বাম – এখানেও দাঁড়ানোর উপায় নেই। পাশের সিটে বসা মধ্যবয়সী এক রমনী আধা-ঘুম থেকে উঠে বললেন ভাই আপনার জন্য আর কোন দাঁড়ানোর জায়গা কি নেই? মহিলার পাশে কেন দাঁড়িয়েছেন? কি আর করা আবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম বাসের দরজার পাশে। ভালই লাগছে কাঁচের ফাঁক গলে হেমন্তের জ্যোৎস্না বিধূত প্রকৃতি দেখছি আর শুনছি গান “এসো এসো আমার ঘরে এসো – আমার ঘরে”।
গাড়ি চলেছে আর দুলছে - একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হলাম।
মেঘযুক্ত ভোরের আকাশ - আয়রন গেট সার্কেল, উইন্ডসর, কানাডা (ছবিঃ লেখক)
আনমনে ভাবছি কখন গিয়ে পৌঁছাব নিজ গৃহে, স্বপ্ন বুনছি কিভাবে কাটাব আগামী কালের ঈদের দিনটি। কিন্তু ঘোর কাটলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই। হঠাৎ শুনতে পেলাম বিশাল হর্নের আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি আমাদের অপরদিক থেকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসছে দুটো গাড়ি- একটি অন্যটিকে অতিক্রম করতে চাচ্ছে বেপরোয়া ভাবে। আর আমাদের ড্রাইভার ভেঁপু বাজালেও তাঁর পাশে যাওয়ারও কোন জায়গা নেই। কারণ রাস্তার পাশেই জনৈক তিন বন্ধু মিলে খোলা আকাশে চাঁদের আলো দেখছে আর গল্প করছে প্রাণভরে। আমি চোখে শুধু ধাঁ ধাঁ দেখলাম আর ভাবলাম আমার নির্ঘাত মৃত্যু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। দাঁতে দাঁত চেপে ধরলাম আর শক্ত করে লোহার খুঁটিটি জড়িয়ে ধরে থাকলাম। এরপর কি হয়েছে কয়েক সেকেন্ড আর হিতাহিত জ্ঞান ছিল বলে মনে হয় না। জীবনে এই প্রথম জানলাম যে দাঁতে দাঁত চেঁপে চলমান সময়কে ও মস্তিস্কের ভিতর স্থবির করে রাখা যায়। এরপর যখন আবদ্ধ সময়ের অবচেতন জগত থেকে চেতনার বহমান সময়ে ফিরে এলাম আমি দেখলাম আমাদের বাসটি ক্রমাগত রাস্তার পাশের খালে পড়ে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন বলেই হয়তো আমি আধা ডুবা হলেও বের হওয়ার জন্য বাসের একটি জানালা খুঁজে পেলাম। কিন্ত উঠব কিভাবে, আমার পা ধরে টানছেন অন্য একজন – ইনি সেই মহিলা যিনি কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলেন ওনার পাশে না দাঁড়াতে। নিয়তির এই কি খেলা এখন উনিই বলছেনঃ “আপনি আমার ধর্মের বাপ – আমাকে অন্ততঃ বাঁচান, আমার মেয়েটা মরে গেছে।”
তখন আমি যাচ্ছি স্কুটারে- ইলিয়টগঞ্জ থেকে কুমিল্লা।
হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি সেই লোক, আমাদের সেই বাস ড্রাইভার। আমি বললাম: ড্রাইভার সাহেব না? আমাকে উনি ইশারায় মাথা নাড়াচ্ছেন হ্যাঁ। জানতে চাইলাম- আপনি কেন পঞ্চাশ জন যাত্রীকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়ে শুধু তিন জনকে বাঁচাতে গেলেন। উনি বললেন আমিও তো একজন মানুষ – “নিজের চোখে দেখে কিভাবে মানুষ মারব? আমি পারি নাই ভাই, আমি পারি নাই”- বলে নিজের অজন্তেই চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
কে কখন কিভাবে কি অবস্থায় থাকবেন সেটা বিধাতাই ভালো জানেন।
না হয় সেই অচেনা মহিলার মেয়ের মতো আমারও তো মৃত্যু হতে পারতো পাশে দাঁড়িয়ে থেকে। শেষটায় আমি তাঁকে বাঁচিয়েছি এটা ঠিক কিন্তু তিনি তাঁর পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে হয়ত নিজের অজান্তেই আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। কে কখন কিভাবে কার উপকারে আসে সেটা হয়তো আল্লাহই ভালো জানেন।
এই প্রথম আমি দেখলাম মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে – দেখলাম মানুষ কতো অসহায় এই মৃত্যুর কাছে।
শুরু করেছিলাম ক্যানাডার ডে লাইট সেভিংস টাইম মানে বছরে দুইবার সময় পরিবর্তনের কথা আর লেখাটা শেষ করছি মৃত্যু নিয়ে।
লেখালেখিও হয়তো জীবন চক্রের মতো, প্রাণের মতো।
-সাইফুল ভুঁইয়া
উইন্ডসর, কানাডা
-
গল্প//উপন্যাস
-
11-01-2021
-
-