অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
রাতভোর বৃষ্টি - সৌম্য ঘোষ

     মস্ত দিনের শেষে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে শিশিরের শব্দের মত আসে সন্ধ্যা। সব পাখি ফেরে ঘরে। এমনই এক আশ্চর্য রাত ছিল সেদিন। মাঝ আকাশে এসেছে চাঁদ একরাশ পাতার পিছনে। তবুও বাতাসে মিশে ছিল জলদ কামনা।
     আজ রাত একটু ভিন্ন ! রাতভোর আকাশ দেখতে আমার  ভালো লাগে ! একা মানুষগুলো  এমন ধারার হয়। কারন তাদের একাকীত্ব জীবনে  অনেক বেশী অগোছালো ।  আকাশ দেখি কারন উদার আকাশের মতো নিখাত বন্ধু আর কাউকেই মনে হয় না। হয়তো আগের মতো আর স্বপ্নময়  নই... কিন্তু  আকাশ দেখতে এখনও ভালো লাগে। পরিশুদ্ধ হই।
     আজকের আকাশ বোধহয় একটু বেশী উদাসী !আষাঢ়ের রাতের আকাশের এটাই এক অনন্য অনুভুতি !
     আজ  চাঁদও উঠেছে আর সে চাঁদকে অনবরত অতিক্রম করে চলছে কিছু দঙ্গল মেঘবালিকা! বালিকারা শ্বেতপরীর মতো চাঁদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কখনো চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে, কখনও বা খোলা আকাশের প্রান্তে উন্মুক্ত। অশান্ত নৈসর্গিক বাতাসে শীতল জলীয় বাষ্পের পরশখানি গায়ে লাগছে।
মনে হলো আকাশের চাঁদমামা আর বেশিক্ষন টিকছেনা ! মেঘ গুড় গুড় শব্দে জানান দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা। আকাশ ক্রমে অনেক বেশী আবেগী হয়ে উঠেছে !
বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না, শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি...
আষাঢ়ের প্রথম রাতভোর বৃষ্টি ! আর এ বৃষ্টি থামার নয়।
মানুষের জীবন আসলে আষাঢ়ের মতই ! এই বৃষ্টিহীন আকাশে অসহ্য রোদের তাপ, রাতে চাঁদের সাথে সাদা-কালো মেঘের ভাব আবার হঠাৎ করেই কালো মেঘের আগমনে শান্তির প্রলেপ।
     অন্তহীন এক গোপন বেদনা অনেকের জীবনে থাকে হৃদয়ের চোরকুঠুরীতে, গোপনে। কেউ প্রকাশ করে আবার কেউ প্রকাশ করতে পারেনা।  দ্বিতীয় গোত্রের মানুষদের অবস্থা আসলেই অনেক করুণ ! কারন না আছে তাদের চারপাশে কেউ,  আর না পারে তাঁরা মন খুলে কথা বলে মনের সবটুকু কান্না ঢেলে দিতে। মনের বেদনা নি:শব্দ ক্রন্দন, চাপা দিতে দিতে তারা নিজেরাই একসময় এক অচেনা গহব্বরে হারিয়ে যায়। যে নিজেকেই আর খুঁজে পায়না।
     আকাশের সাদা মেঘবালিকারা যারা এতক্ষণ নবযৌবন সমাগতা দেবকন্যার মতো ছিল উচ্ছ্বল-তরঙ্গায়িত। প্রেম-পিয়াসি সেই কন্যারা দেবকুমারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে স্বতোজ্জ্বল ভালোবাসার তিয়াসী বাসনা নিয়ে ছিল আকুল। ষোড়শীর হৃদি- সরসিজ প্রেমে উদ্দাম। সহসা তখন কালোমেঘ এসে জমা  হয়, অদৃশ্য হতে থাকে  আকাশের সাদা মেঘরাশী। কালো মেঘরাশী দখল নেয় সমগ্ৰ আকাশ।  অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়।   কালো মেঘগুলো আঁধার ছড়িয়ে আনে বৃষ্টির সুবাস।
     অবিরাম সে বৃষ্টি চলে অনেকক্ষণ কিন্তু তা থেমেও যায় ! কিন্তু এ থেমে যাওয়ার মানেই কি সব থেমে যাওয়া ? সব শেষ হয়ে যাওয়া ? বর্ষাসুন্দরী ঋতুরানী, হৃদয়ের গোপন ক্রন্দন বৃষ্টিভেজা রাতে অমলিন হয়।
    বৃষ্টি চলছেই অবিরাম টুপটাপ, বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়ালাম অশান্ত বর্ষণের মুখোমুখি । ভিজে রাতে শব্দহীন নীল অন্ধকারে যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি, কোন বিলুপ্ত নগরীর কোন বিলুপ্ত নারীর কথা মনে পড়ে। স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে জলন্ত মেঘে হৃদয়ের টানে ভেসে যায় বর্ষার রাত। বৃষ্টি ভাঙছে বিপন্নতার ক্ষতে। অভিমানের আর্দ্র মেঘে মগ্ন পাতায় রোপন করে ভালোবাসার বীজ! প্রেয়সী ছাড়া জলদ মেঘ যেন অসম্পূর্ণ।  রাতভোর বর্ষায় মন সঙ্গী খোঁজে।
মিলনের বৃথা প্রত্যাশায় ভরা বর্ষার এই মায়াবী সন্ধ্যায় বা নির্জন রাতে কেবলই পথ চাওয়ার ব্যাকুলতা। ব্যথিত হৃদয় বৃষ্টির  মর্মর ছন্দে ভাষা খুঁজে বেড়ায় -
" আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল  দিনে,
জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না..."

সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ