অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাফারীর দেশে তিনবছর – চিরঞ্জীব সরকার

    মি ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত   কেনিয়াতে থাকি। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক নাম শুনেছিলাম। সাহারা মরুভূমি, ঘন জঙ্গল, বিচিত্র গাছপালা, বৈচিত্রপূর্ন মানুষ, নানান জাতের পশুপাখি ইত্যাদি কত কিছুই না মনে পড়ে আফ্রিকার কথা ভাবতে। মনে মনে তাই একটা বাসনা ছিল যদি আফ্রিকায় কোনদিন যেতে পারি। বাসনাটি মনে হয় সৎ ছিল তাই তা একদিন পূরন হল। টিকিট কেটে ফেললাম। আমিরাতের আকাশযানে দুবাই হয়ে নাইরোবী। দুবাইতে কয়েক ঘন্টার ট্রানজিট। আকাশ থেকে নাইরোবী দেখছি আর ভাবছি তাহলে আমি কি সত্যিই আফ্রিকায় পদার্পন করতে যাচ্ছি। প্লেনের চাকা স্পর্শ করল নাইরোবীর জোমো কেনিয়াটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ওখান থেকে নাইরোবী শহরের দিকে গাড়ি ছুটে চলছে। দেখলাম এয়ারপোরর্টের পাশেই নাইরোবী ন্যাশনাল পার্কের কাঁটাতারের বেড়া। পৃথিবীতে নাকি এটাই একমাত্র সাফারী পার্ক যা কোন দেশের রাজধানীর একেবারে ভিতরে অবস্থিত।
     আমাদের অফিসটি তখন নাইরোবীর  কিলিমানি রোডে ছিল। কেনিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মিউই কিবাকির স্ত্রী লুসি কিবাকি এটার মালিক। ভিতরে বেশ কিছু বড় বড় গাছ ছিল। এর ভিতর একটি ছিল বিশাল এক ক্যাকটাস গাছ যেটিতে মাঝে মাঝে খুব সুন্দর ফুল ফুটে থাকত। পিছনে ছিল একটি অ্যাভাগেডো গাছ। প্রচুর ফল ধরত গাছটিতে। সিকিউরিটি গার্ড চার্লস মাঝে মাঝে এগুলি এনে আমাদেরকে দিত। অ্যাভাগেডো একটি খুবই উপকারী ফল। সবুজ হালকা ফলটির হলুদ বর্নের ভিতরেরটা খেতে মাখনের মত। ঢাকার সুপারসপগুলির সেলফে এ ফলটি এখন দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও  গ্যারেজের কাছে একটি প্যাসন ফলের লতানো গাছ ছিল। প্যাসন ফল খেতে বেশ টক তবে এর একটি দারুন সুমিস্ট গন্ধ আছে। মাঝে মাঝে গাছপালা বেয়ে অফিসের সন্মুখের খোলা ঘাসের  আঙ্গিনায় বেশ বড় বড় শাখামৃগ বা বানর আসত। আমার সাথে ওদের চোঁখাচোখি হত নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে। গাছের ডালে দেখতাম বিশাল ঠোঁটের হর্নবিল বা ধনেশ পাখি। কেনিয়ায় আসার কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আফ্রিকা হল বিচিত্র পশুপাখি আর গাছপালায় সমৃদ্ধ দারুন বৈচিত্রময় এক মহাদেশ।
     পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। ক্রিকেটের বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষও একটা সময় এ দেশটিকে চিনত। কিন্তু ক্রমাগত খারাপ খেলায় দেশটি এখন ক্রিকেট থেকে সরে এসেছে। তবে দূরপাল্লার দৌড়ে এখনও পৃথিবীর অন্যতম সেরা দেশ। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পিতার দেশও ছিল কেনিয়া। দেশটির ভাল মানের চা ও কফি উৎপাদনের জন্য বেশ সুনাম রয়েছে। এছাড়াও অন্য যে কারনে কেনিয়ায় সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকেরা আসে তা হল বিশ্বখ্যাত মাসাইমারা সাফারী পার্ক পরিদর্শনে। বছরের একটি বিশেষ সময়ে হাজার হাজার ওয়াইল্ড বিস্ট যা দেখতে অনেকটা মহিষের মত পার্শ্ববর্তী দেশ তাঞ্জানিয়া থেকে দলে দলে নতুন ঘাসের সন্ধানে মারা নদী ক্রস করে কেনিয়াতে প্রবেশ করে। মারা নদীর হিংস্র কুমিরগুলি ওয়েট করতে থাকে কখন ওয়াইল্ডবিস্ট ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠবে। প্রানিজগতের ‘সারভাইভাল অব দি ফিটেস্টের’ এ  যেন এক  জীবন্ত চিত্র। কেনিয়ায় থাকাকালে আমিও সপরিবারে একদিন মারা নদীর তীরে গিয়েছিলাম। মারা নদীর পানিও একটু স্পর্শ করলাম। সেদিন মারা নদীর কুমির দেখেছি তবে সেটা পানিতে নয় তীরে। মাসাইমারার লম্বা গলাওয়ালা জিরাফগুলি যখন নিঃশব্দে গলা উঁচু করে  স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে থাকে তখন মনে হয়  সময় ও সভৎতা যেন কোন এক আদিম ডাকে এখানে থেমে গেছে আর সবাইকে বলছে একটু হলেও এবার থাম।


     কেনিয়ার  রাজধানী নাইরোবীর আবহাওয়া বেশ চমৎকার। মনে হয় যেন ন্যাচারাল এসি। তেমন কোন ফ্যান বা এসির ব্যবহার করতে হয় না। সম্ভবত এ কারনেই জাতিসংঘের দুটি গুরুত্বপূর্ন সংস্থা ইউনেপ ও ইউএন হ্যাবিটাটের সদর দপ্তর নাইরোবীতে। গিগিরীতে অবস্থিত এ অফিস দুটিতে বহুবার যেতে হয়েছে দাপ্তরিক কাজে। বাংলাদেশের কিছু ছেলেমেয়েও ওখানে তখন কর্মরত ছিল। নাইরোবী থেকে ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভের পথ নাইভাসা লেক। নাইভাসা লেকে দেখতে পাওয়া যায় জলহস্তির পরিবার। অনেক সময় ওরা পানির ভিতর মাথা জাগিয়ে চুপ করে ভাসতে থাকে। কখনো কখনো তীরে উঠে। এ সময় দেখা যায় তাদের নাদুস নুদুস বিশাল দেহ। এ লেক থেকে জেলেরা তাজা মাছ ধরে। একবার ওয়াল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে (ডাব্লিউটিও) কর্মরত আমার ব্যাচমেট ও বন্ধু তৌফিক নাইরোবীতে বেড়াতে এলে ওকে নাইভাসা লেকের একেবারে মাঝে বসে বোট থেকে একটি বড় রুই মাছ কিনে দেই। মাছটি ও প্যাক করে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নিয়ে যায়। মহাখুশিতে সে ওখানকার বাংলাদেশীদের সে মাছটি বেশ কয়েকদিন ধরে মহা আনন্দে পরিবেশন করেছিল এবং প্রত্যেকবারই আমাকে জেনেভা থেকে টেলিফোন করে ব্যাপারটা জানাত। মাছকে কেন্দ্র করে এরকম ভিআইপি ট্রিটমেন্ট আমি আর কখনো দেখিনি।
     কেনিয়া দেশটি নিজেই একটা সাফারী। রাস্তা  দিয়ে গাড়ীতে চড়ে দুদিকে তাঁকালে হরিণ, জেব্রা, বুনো মহিষ ইত্যাদি অনেক বন্য প্রানী চোখে পড়ে তার বিশাল তৃনভূমিতে।  মাসাইমারাতে ওয়াইল্ড বিস্ট ছাড়াও দেখতে পাওয়া যায় সিংহ, হাতি, চিতাবাঘ, জিরাফ,জেব্রা,হায়েনা, বুনোমোষ ইত্যাদি নানা ধরনের বন্যপ্রানী। মাসাইরা বর্শা হাতে তাদের পশুর পালকে পাহারা দেয় অসীম সাহসিকতার সাথে। মাসাইদদের  মাটির তৈরী ঘরগুলি ছোট ছোট আয়তকার।এরকম অনেকগুলি ঘর নিয়ে এক একটি মাসাইপাড়ার অবস্থান। জন্ম থেকেই মাসাইরা জানে কিভাবে হিংস্র সিংহ বা হায়েনার দলের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। মাসাইদের পোষাকও বেশ রঙ্গীন।কাঠ বা হাড় দিয়ে তৈরী নানান ধরনের অলঙ্কার  তারা পড়ে। সিংহ বা হাতি অনেক সময় মাসাইমারার সাফারীতে রাস্তা আটকিয়ে বসে বা শুয়ে থাকে। রাত নেমে আসলে বন্য প্রনীদের নানান ধরনের চিৎকারে আমরা যারা এ বন্য জীবনের সাথে তেমন পরিচয় নেই তাদের রক্ত শিরশির করে উঠে। বিচিত্র আফ্রিকার জীবন স্পন্দনও বিচিত্র।
     কেনিয়া থাকাকালে লেক ভিক্টোরিয়া ও মোম্বাসাতেও গিয়েছিলাম। নাইরোবী থেকে মোম্বাসা যাওয়ার পথে দেখা যায় গ্রামীন আফ্রিকাকে। ছোট ছোট গ্রাম, লাল মাটি, কোকরানো চুলের আফ্রিকার সহজ সরল মানুষগুলি। মোম্বাসায় সমূদ্র কোলঘেষে অবস্থিত একটি হোটেলে ছিলাম। এটি একটি পোর্ট সিটি। একটা নৌকা ভাড়া নিয়ে বীচে ঘুরলাম। সমূদ্র আমাকে সবসময়ই টানে। বেলাভূমির বালুকারাশিতে নিজেকে প্রানভরে মিশিয়ে নিলাম। ইট পাথরের শহুরে জীবনধারায় সমূদ্রকে কাছে পেয়ে তাই জাপটে ধরতে ইচ্ছে করে। হোটেলের সামনের বীচে খোলা চেয়ারে আকাশভাঙ্গা চাঁদের জোছনার সে রাতে অনেকক্ষন শুয়ে ছিলাম। আফ্রিকা ছেড়ে আসার অনেকদিন পরও এখনো ডাকে তার নিবিড় জঙ্গল, বিস্তৃর্ন তৃনভূমি, সহজ সরল মানুষগুলি, জীবজন্তু তথা তার আদিম প্রকৃতি।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা