অটোয়া, শুক্রবার ১৩ জুন, ২০২৫
অতীন্দ্রিয় – ফরিদ তালুকদার

(অতীন্দ্রিয়, ‘নক্ষত্রহীন রাতের আকাশ’ এর একটি উপস্থাপন / A presentation from ‘Starless Night Sky’)
--- বাঁকের মুখে হারিয়ে যাওয়া নদীটার গল্প তো তুমি আর শেষ করলে না বাবা? 

--- আমার মস্তিষ্ক অসার। বুকের গহীনে অসীমতার ঢেউ। এ গল্পের কোনো সমাপ্তি রেখা যে আমার জানা নেই মা! বরং তোর কথা বল। তুই কি অবাক বিস্ময়ের সেই শিশু এখনো আঙুর ঝাড়ের মাচায় রেকুনের (Racoon) আঙুর খাওয়ার দৃশ্যে বিভোর!? 

--- ওহ্ হো--- সেই কথা!?  তোমার এখনো মনে আছে তা!? তুমি তো ছিলে না তখন। নিশ্চয়ই মামনী বলেছে তোমাকে?

রাত তখন অনেক। ঝাড় উপচে পড়া নীল রঙের আঙুর! আমাদের জীবনে কখনো কখনো বেদনা যেমন উপচে পড়ে, ঠিক তেমনি!  তবে নিশ্চয়ই ওটা ছিলো আঙুর গাছের সুখ। সুখ রেকুনেরও! আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। কিন্তু জানালার ওপাশ থেকে থেমে থেমেই বেশ বড়সড় ঝড়ের মতো একটা শব্দ আসছিলো। মনে হচ্ছিলো কেউ যেন পৃথিবীটাকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে! চুপিসারে বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দেখি বিশাল আকৃতির চার রেকুন আঙুর ঝাড়ে মহাসমারোহে তাদের রাজত্ব গেড়ে বসেছে! সে কী তান্ডব! দুই হাতে হাপুসহুপুস চলছে তাদের আঙুর ভোজ। ফাঁকে আবার তীর্যক চোখে আমাকে একটু দেখে নিচ্ছিল ওরা! ওদের হাত ফসকে কিছু আঙুর ঝরে পড়ছিল তলায়। ওদিকে ওদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এই পৃথিবীর অপচয়ী কিছু লোকের মত! আমি নিষ্পলক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। টের পেয়ে এর মধ্যে মামনিও কখন এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছে আমার পেছনে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো যাও এখন গিয়ে শুয়ে পড়ো, রাত হয়েছে বেশ। কিন্তু এতোদিনেও তুমি ওটা মনে রাখলে কী করে!? 

নাহ্ আমি এখন আর সে দৃশ্য দেখছি না বাবা। আমি এখন—, আমি এখন---!! নাহ্ বলবো না। বরং যখন সময় হবে তুমি এসেই দেখ!?

--- মনে থাকবে না কেন মা? পৃথিবীতে আসার সময় পর্যবেক্ষণ স্পিকারে তোলপাড় তোলা তোর হার্টবিটের সেই শব্দ যে এখনো পরিস্কার আমার শ্রবণকে আসক্ত করে রাখে!

তোকে একটা খবর দেই ময়ী---

--- বলো---?

--- আঙুর গাছগুলো আর থাকছে না!

কেন? কী হয়েছে!? 

--- পরে কখনো বলবো। জানিসই তো, ওরাও আমাদের মতো। এখানে আমরা সবাই যে  বেড়াতে আসি মাত্র। কেউ এক মিনিটের জন্যে, কেউ  বা একশো বছরের জন্যে। অথচ অনিশ্চিত এই সময়টুকুতে ধরিত্রী মাতার উপরে আমাদের তান্ডবও কিন্তু কম নয়! জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের দরকার। কিন্তু তাকে হামেশাই আমরা যে ভোগে রূপ দিয়ে পৃথিবীর সুখে করাত চালাই!

--- সে তোমাদের বড়দের ভাবনা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।

--- কী কথা?

--- আমি ভাবছি সন্তানদের জীবনের উপর দিয়ে তোমরা যে তোমাদের স্বপ্নের চাকা ঘুরাও---। আর এটা করতে গিয়ে কতো  সন্তানের জীবনকে যে তোমরা অকাল মৃত্যুর পথে ঠেলে দাও, সভ্যতার কোনো শুমারী কেন সে খবর রাখে না!? যারা বেঁচে থাকে তাদের বাকী জীবনের সত্যিকারের সুখের অপমৃত্যু যে আতুর ঘরেই ঘটে গিয়েছে সে খবরও তারা কোনোদিন আর জানতে পারে না! অথচ মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তোমরা তার সাফল্যের জয় কীর্তন করো আমাদের সন্তান এই হয়েছে, ঐ হয়েছে! কিন্তু কোনোদিন জানতে চাওনি সে  সত্যিই কী হতে চেয়েছিলো? সে হয়তো একজন উদ্ভিদ বিশারদ হতে চেয়েছিলো। কিংবা একজন ফুটপাতের পর্যটক! আর সেখানেই হয়তো সে সুখী হতো তার মতো করে। কিন্তু তা হয়নি! কেবল সুখ নামক এক মরিচীকার উপরে হেঁটে হেঁটে জীবন গোধূলিতে এসে দাঁড়ায়  সে। তারপর দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাসে একবার শুধু পেছন ফিরে তাকায়! হয়তো তখন তার আর মনেও পড়ে না কী চেয়েছিলো সে ছোট্ট এই জীবনে। কিন্তু দীর্ঘশ্বাসটা তাকে যে ছেড়ে যায় না কখনোই! সংবেদনশীল মনের এক অবচেতন কক্ষে আমৃত্যু ঐ দহন চলতে থাকে! হয়তো নিজেই আর সে আবিস্কার করতে পারে না কিসের এই দহন? কেন এই দহন!?  

মহান লেখক হারমান হেস তার ‘বিনীথ দ্যা হুইল' (Beneath the wheel, Hermann Hesse) উপন্যাসটায় শত বছরেরও পূর্বে তোমাদের সামনে পরিস্কারভাবে এই ছবিটা তুলে ধরেছেন। অথচ এতোটা বছর পরেও তোমরা তা আত্মস্থ করতে পারলে না কেন বাবা!?

--- এ প্রশ্ন এখন যে নিরন্তর আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ময়ী! আমার যে মুক্তি নেই কোনো! প্রফুল্ল নদীর মতো বহতা কতো জীবন যে একারণে বাঁক নিতে নিতে হারিয়ে যায় অসীমের ঠিকানায়---, এ সত্য এখন আমার চেয়ে আর কে বেশি বুঝে মা! 

গল্পটা যে কেন আর শেষ করতে পারলাম না জানিস?  

--- কেন?

--- যখনই লিখতে বসি ব্যাথার অসীম সেই ঢেউয়ের উপর আমি যে শুধু একটি নীল গোলাপ দেখি মা, “একটি নীল গোলাপ”!

--- জানি বাবা, আমি জানি। তবুও জানতে ইচ্ছে হলো যে---!!

ফরিদ তালুকদার। টরোন্ট 
জুন ২৪, ২০২২