বাঁশের সাঁকো - গোলোকেশ্বর সরকার
যাত্রী সে যে ওরে
হেমতাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে টোটো চলছিল পকেট--রুটের রাস্তা ধরে । পাকা রাস্তা । রাস্তার অবস্থা ভালো । টোটো চলছিল গড়গড় করে, মসৃনভাবে । তেমন ঝাঁকুনি হচ্ছিল না । টোটোতে বৃদ্ধ আশির্বাদ ও যুবক সাধন । পেছনের আসনে আশির্বাদ ও সাধন দু'জন পাশাপাশি বসে । সাধন একহাত দিয়ে আশির্বাদকে শক্ত করে ধরেছিল । টোটোতে ওঠার সময় আশির্বাদ টোটোর তিনটে চাকা বেশ করে পরখ করে টোটো চালককে জিজ্ঞেস করেছিল, চাকাগুলো ভালো আছে তো ?"
টোটো চালক বলেছিল," হ্যাঁ, চাকাগুলো একদম নতুন । রাস্তা ভালো, চাকা নতুন । তাই রাস্তার মাঝে চাকা ফুটো হয়ে যাওয়া বা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম ।" আশির্বাদের টোটোটা পছন্দ হয়েছিল । সাধনের হাত ধরে টোটোটিতে উঠেছিল বৃদ্ধ আশির্বাদ ।
আশির্বাদের বয়স পঁয়ষট্টি বছর । অবিবাহিত । গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা । ' আপন জন ' নামে একটি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত । আশ্রমই তার ঘর, আশ্রমই তার ঠিকানা । আশ্রমের অনাথ বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখায় । নিয়মিত পরিচর্যা করে, জল দিয়ে আশ্রমের গাছগুলোকে সবুজ রাখে ।
সাধনের বয়স ঊনিশ বছর । কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র । প্রেম করে । আশির্বাদের কাঁধে একটি ব্যাগ । হাতে একটি ভর দিয়ে চলার লাঠি । কয়েক বছর ধরে লাঠি ছাড়া আশির্বাদ হাঁটতে পারে না ।
আশির্বাদ একটু হেলে টোটোর সামনের চাকা এবং এদিক--ওদিক বসে পেছনের চাকা দুটো ভালোভাবে লক্ষ করছিল । চাকার দিকে তাকিয়ে আশির্বাদ দেখছিল, চাকা কীভাবে তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছিল । নজর রাখছিল, কীভাবে তিনটে চাকা তাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের গন্তব্যস্থানের দিকে পৌঁছে দিচ্ছিল । আশির্বাদ আসনের মাঝে স্থির হয়ে বসে বলল, " সাধন, বলতে পারবি চাকার জন্ম হয়েছিল কেন ?"
সাধন কলেজ পড়ে । তবে চাকা সম্পর্কে তার তেমন জানা ছিল না । সাধন উত্তর দিল, "না ।"
আশির্বাদ জানাল, "বহু বছর আগে কোনও কিছু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল । কোনও জিনিস এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাকার জন্ম হয়েছিল ।"
সাধন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, " দাদু, কী দিয়ে প্রথম চাকা তৈরি হয়েছিল ?"
আশির্বাদ বলল, " কাঠের গুঁড়ির চাকতি দিয়ে প্রথম চাকা বানানো হয়েছিল ।"
সাধন প্রশ্ন করল, " সেই পুরনো সময়ে মানুষের মনে চাকার ব্যাপারটা এসেছিল কীভাবে ?
আশির্বাদ উত্তর দিল, " সম্ভবত, পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়তে দেখে মানুষের মনে চাকার ধারণা এসেছিল ।"
আশির্বাদ আবার বলল, " বুঝলি সাধন, চাকা মানুষকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় টেনে নিয়ে যায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে চলে । যেমন, চাকা আমাদের ডালখোলা থেকে হেমতাবাদে নিয়ে এসেছে আবার হেমতাবাদ থেকে মেলাতে নিয়ে চলেছে । চাকা নিজেই আমাদের বহন করে নিয়ে চলেছে ।
ডাক দিয়েছে সে
টোটো চলছিল গ্রামের রাস্তা ধরে গ্রামের মেলার উদ্দেশ্যে । যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ গাছপালা আর সবুজ শস্যক্ষেত । সবুজের সৌন্দর্যে মন তরতাজা হয়ে উঠল আশির্বাদের ।
আশির্বাদ বলল, " জানিস সাধন, ডাক্তারবাবুরা বলেন, সবুজ রং চোখের পক্ষে খুবই উপকারী । কিন্তু শুধু চোখ নয়, সবুজ রং চোখের সাথে-- সাথে মনকেও ভালো রাখে । সবুজের সমারোহ দেখে সাধনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, "খুবই সুন্দর ! অপূর্ব !"
আশির্বাদ শ্বাস টেনে বুক ভরে গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস নিল । বলে উঠল, " কি আরাম ! কি প্রশান্তি !" সাধনকে বলল, " জানিস সাধন, যে--গ্রামকে আমরা অবহেলা করি, এমন একদিন আসবে, যেদিন শহরের লোকেরা গ্রামে ছুটে আসবে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য , আসলের খোঁজে , খাঁটির সন্ধানে ।"
আশির্বাদ জিজ্ঞেস করল, " সাধন, 'মেলা' কথার মানে কি জানিস ?"
সাধন বলল, " হ্যাঁ । 'মেলা' শব্দের অর্থ মিলন ।
চাকা কিন্তু আপন মনে তার কাজ ঠিক মতো করে যাচ্ছিল । কর্তব্যে গাফিলতি ছিল না তার । নিজস্ব গতি নিয়ে এগিয়ে চলছিল সামনের দিকে । লক্ষে স্থির চাকা ।
আশির্বাদ প্রশ্ন করল, " সাধন, গ্রামের মেলায় গিয়েছিস কখনও ?"
সাধন জানাল, " ছোট বেলায় বাবা--মা'র হাত ধরে গ্রামের মেলায় গিয়েছি । বড় হয়ে গ্রামের মেলায় আর যাওয়া হয়নি । মেলা মানে একে অপরের সাথে প্রাণ খুলে মেশা । মেলা মানে শুধু খুশি আর খুশি ,আনন্দ আর আনন্দ ।"
সাধন বলতেই বলল, " গ্রামের মেলা বছরে কোনও নির্দিষ্ট দিনে অথবা তিথিতে হয়ে থাকে । গ্রাম্য মেলাতে থাকে মাটির স্বাদ । গ্রামের মেলা প্রকৃতির মাঝে কোন ফাঁকা জায়গায় কিংবা খেলার মাঠে বসে । কোথাও মেলা সকাল থেকে বসে, কোথাও দুপুর থেকে বসে । সাধারণত মেলা চলে রাত পর্যন্ত। তবে দূরের লোকেরা সন্ধের পরে বাড়ি ফিরতে শুরু করে ।
সাধন প্রশ্ন করল, " দাদু, মেলাতে আপনি কীজন্য যাচ্ছেন ?"
আশির্বাদ বলল, "এই মেলাতে ' অম্বালিকা' আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে । লোক মারফৎ আমাকে এই মেলাতে ডেকে পাঠিয়েছে । তিরিশ বছর পর আমাদের দেখা হবে ।"
পায় না দেখতে দু'চোখ তাকে
টোটোর তিনটে চাকা সম্মিলিতভাবে আশির্বাদ আর সাধনকে এক জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করালো । টোটোর চাকাগুলো এক জায়গায় স্থির হয়ে স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করল । যে--কর্তব্য তাদের ওপর ছিল, তা তারা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছে ।
টোটোওয়ালা বলল, " দাদু, আপনার জায়গা এসে গেছে ।" আশির্বাদ বলল, " জানি । এই জায়গা আমার চেনা । সাত বছর আগে একবার বন্ধুর সাথে এখানে মেলা দেখতে এসেছিলাম ।"
টোটোতে বসে থেকে আশির্বাদ সাধনকে বলল, " সাধন, আমার ব্যাগটা নে আর আমার হাতটা একটু ধর । আমি নামব ।" সাধন এক হাতে ব্যাগটি নিল । অন্য হাতে আশির্বাদের বা'হাত ধরল । আশির্বাদ ডান হাতে লাঠিতে ভর করে টোটো থেকে নামল । ভাড়া মিটিয়ে দিলে টোটোওয়ালা চলে গেল । আশির্বাদ বলল, " সাধন, আমাকে ভালো করে ধরে রাখিস । নইলে পড়ে যেতে পারি ।" সাধন শক্ত করে আশির্বাদের ডান হাত ধরে থাকল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল আশির্বাদ ।
লাঠি হাতে ধরে ঠকঠক করে কিছুটা পথ চলার পর আশির্বাদ একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল । আশির্বাদ বলল, " সাধন, এই জায়গাতেই মেলাটি হয় ।" সাধন বলল, "দাদু, এখানে তো নাগরদোলা, সার্কাস,পুতুলনাচ, ম্যাজিক প্রদর্শনী কোনওটাই দেখছি না ।" আশির্বাদ বলল, "ওগুলো এই মেলায় বসে না । " আশির্বাদ ব্যাগ থেকে দুটো আসন বের করল । আসন দু'টি মাটিতে পাতল । সাধনকে একটি আসন দেখিয়ে বলল, " সাধন, বোস । আসনটিতে বোস ।"
সাধন আসনে বসল । অপর আসনে আশির্বাদ বসল । আশির্বাদ ব্যাগের ভেতর থেকে লাল ও হলুদ রঙের দুটো ফোল্ডিং ছাতা বের করল । হলুদ রঙের ছাতাটি সাধনকে দিয়ে লাল রঙের ছাতাটি নিজে নিল । আশির্বাদ লাল রঙের ছাতাটি ফুটিয়ে নিজের মাথায় দিল । সাধনকে ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিতে বলল । সাধন বলল, " দাদু, আমি কিন্তু এই মেলাতে কোনও দিনও আসিনি ।" সকাল সাড়ে-- এগারোটা বাজে । মাথার ওপর সূর্য । দু'জনে ছাতা মাথায় দিয়ে মাটিতে পাতা আসনে বসে রইল বিস্তীর্ণ মাঠের একধারে ।
তবু শুরু হলো মেলা
গতকাল আশির্বাদ সাধনকে বলেছিল, "সাধন, আমি আগামিকাল এখান থেকে অনেকদূর হেমতাবাদে এক মেলাতে যাব । কিন্তু শরীরটা আমার ভালো লাগছে না । দুর্বল লাগছে । মাঝে--মাঝে মাথা ঘুরছে । তুই যদি আমার সাথে যাস, আমার সঙ্গে থাকিস, আমাকে সাহায্য করিস, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি । মেলাটিতে আমার যেতেই হবে ।"
আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে সাধনের বাড়ি । সাধন জিজ্ঞেস করেছিল, কখন যাবেন ?" আশির্বাদ বলেছিল, " ভোরবেলা যাব, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব । তোর যাতায়াত, খাওয়া--দাওয়া সমস্ত খরচ আমি দেব । গ্রামের মেলা ।"
সাধন আশির্বাদের কথা ফেলতে পারেনি ।
আশির্বাদ সাধনের বাবা--মাকেও বলেছিল কথাটা । সাধনের বাবা--মাও সম্মতি জানিয়েছিল । মা সাধনকে বলেছিল," সাধন, দাদুকে একা--একা ছাড়বি না । দাদু অসুস্থ । দাদুর সাথে--সাথে থাকবি । দাদুকে ধরে রাখবি ।" সাধন বলেছিল, " ঠিক আছে মা ।" ভোরবেলা সাধন আশির্বাদের আশ্রমে এসে হাজির হয়েছিল । সাধন দেখেছিল, আশির্বাদ আগের থেকে তৈরি হয়ে বসেছিল ।
উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ মোড় থেকে অনেকটা ভেতরে মেলাটি হয় । আশির্বাদ ও সাধনের বাড়ি এই জেলারই ডালখোলা নামে জায়গায় । ডালখোলা থেকে রায়গঞ্জ আবার রায়গঞ্জ থেকে হেমতাবাদে বাসে করে আসতে সকাল দশটা বেজে গিয়েছিল । হেমতাবাদে হোটেলে দু'জনে ভাত খেয়ে সকাল সাড়ে দশটায় মেলার উদ্দেশ্যে টোটো ধরেছিল ।
সাধন ছাতা মাথায় বসে থেকে চারদিকে তাকাল । দেখল, অনেকদূর পর্যন্ত কোনও বাড়িঘর নেই । ফাঁকা মাঠ । কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছে । সামনের দিকে কাঁটাতারের বেড়া । সাধন কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আশির্বাদ বলল , "ওটা ভারত--বাংলাদেশ কাঁটাতারের বেড়া । ওপারে বাংলাদেশ এপারে ভারত ।" সাধন জিজ্ঞেস করল, "দাদু, মেলা কখন শুরু হবে ?" আশির্বাদ বলল, " অনেকক্ষণ আগে মেলা শুরু হয়ে গেছে । প্রতিবছর আজকের দিনে মেলাটি হয় । ওই যে লোকগুলো ঘোরাঘুরি করছে, ওরা মেলারই লোক ।" সাধন চারদিক তাকাল । তারপর আশির্বাদকে বলল, "দাদু, এখানে তো কোনও মিষ্টির দোকান, জিলিপির দোকান, মনোহারি দোকান, মাটির তৈরি জিনিসের দোকান, হাতের কাজের দোকান, বেলুনওয়ালা, বাঁশিওয়ালা কোনও রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না । তাহলে মেলা কই ?"
আশির্বাদ উত্তর দিল, " এই মেলাতে ওসব কিছুই দেখা যায় না । ওসব কিছু আসে না এখানকার মেলাতে "
সাধনের মাথায় কিছু ঢুকল না । সাধনের মাথা গুলিয়ে গেল । সাধন আর কোনও কথা না বলে চুপ করে রইল ।
একে-- একে অনেক লোক আসতে লাগল । যুবক, যুবতী, বিবাহিত ছেলেরা , বউরা ,পৌঢ়,পৌঢ়া, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সকলে এই জায়গায় এসে জমায়েত হতে লাগল । সাধন দেখতে পেল, কিছু সময়ের মধ্যে লোকে ভরে গেল ফাঁকা মাঠ । শয়ে শয়ে লোক । সাধন জিজ্ঞেস করল, " দাদু, এখানে এত লোক কেন জমায়েত হচ্ছে ?" আশির্বাদ বলল, " এই সমস্ত লোক মেলার লোক । সব লোক এখানকার মেলাতে এসেছে । "
সাধনের কোনও কিছু বোধগম্য হলো না । সাধন লক্ষ করল, কাঁটাতারের ওপারেও অনেক লোক । সাধন বুঝল, এখানকার মেলাটা খুব বড় ও বিখ্যাত মেলা । তাই ওপারের লোকজনও এই মেলা দেখতে এসেছে ।
সাধন বলল, " দাদু, অম্বালিকার বয়স কত হবে?"
আশির্বাদ বলল, " একষট্টি বছর ।"
"দেখতে কেমন ?"
"খুবই সুন্দর । গায়ের রং ফর্সা । ঘন কালো চুল ,চোখ দুটো টানাটানা । মাঝারি উচ্চতা ।"
"ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করার কোনও সময় দিয়েছে কি ?"
" হ্যাঁ । ঠিক বিকেল সাড়ে তিনটে ।"
বৃষ্টি ঝরে ঝমঝম
অল্প সময়ের মধ্যে মেঘে ঢেকে গেল আকাশ । কিছুক্ষণ আগে যে--সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল, সেটা উধাও হয়ে গেল । গুমোট আবহাওয়া । কেউ কেউ বলতে লাগল, " বৃষ্টি আসবে বোধ হয় ।"
সাধন দেখল, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত লোক একসঙ্গে জোরে কেঁদে উঠল। জোরে--জোরে কান্না । হাউ -- হাউ করে কান্না । কান্নার শব্দে ভরে গেল সারা মাঠ । ভরে গেল চারদিক । আকাশে বাতাসে শুধু কান্না শুধু কান্না । আশির্বাদও কাঁদতে শুরু করল । দু'চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার । কিছুক্ষণ পর সকলের কান্নার তীব্রতা ধীরে--ধীরে কমে গেল । হেঁচকি তুলতে তুলতে আশির্বাদের কান্না থেমে গেল ।
সাধন আশ্চর্য হয়ে গেল । আশির্বাদকে জিজ্ঞেস করল, " দাদু, সকলে একসাথে এমন কেঁদে উঠল কেন ? আপনি অঝোরে কাঁদছিলেন কেন ?"
আশির্বাদ বলল , " মেলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে । এটা কাঁদাকাঁদির মেলা । এই মেলায় আসা লোকেরা তাদের আত্মীয়-স্বজন-- প্রতিবেশি --বন্ধুদের দু'চোখ ভরে দেখে আর কাঁদতে থাকে । অনেক সময় ধরে চলে এই মেলা । প্রথমে কান্না ধীরে-- ধীরে হয়, তারপর কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে । একসময় সবাই খুব জোরে-- জোরে কাঁদতে শুরু করে ।"
আশির্বাদ সাধনকে বলতে থাকল, " ওই যে কাঁটাতারের দেখছিস, ওই বেড়ার এপারে ভারত আর ওপারে বাংলাদেশ । ভারতের লোকেরা তাদের বাংলাদেশের আত্মীয়--স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধুদের দেখে কাঁদতে থাকে । আবার বাংলাদেশের লোকজন তাদের ভারতের আত্মীয়,বন্ধু, পড়শিদের দেখে অঝোর ধারায় কান্না করে । কাঁটাতারের বেড়ার এপারের ভারতের লোকজন আগে ওপারে বাংলাদেশে থাকত । ওপার থেকে তারা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করে । দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় বছরের আজকের বিশেষ দিনে দু'পারের লোকজন দু'পারের লোকজনকে দু'চোখ ভরে দেখে আর কাঁদে । অজস্র ধারায় কাঁদে । শুধু কাঁদে, শুধু কাঁদে,,,,,,,, "
সাধন সামনের দিকে তাকাল । দেখল, লোকগুলো তখনও কাঁদছিল । নিচু স্বরে কাঁদছিল । সকলের চোখে জল । ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ছিল ।
সাধন তার হাত--ঘড়ি দেখল । দেখল, দুপুর আড়াইটে বাজে । আর এক ঘন্টা বাকি অম্বালিকা আসার ।
সাধন আশির্বাদকে জিজ্ঞেস করল, "দাদু, অম্বালিকা আপনার কে হন ?"
আশির্বাদ বলল, " তিরিশ বছর আগে অম্বালিকা আমার প্রেমিকা ছিল । আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসতাম । এখন অম্বালিকার স্বামী আছে, সংসার আছে, ছেলে--মেয়ে আছে । তিরিশ বছর আমাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না ।"
সাধন জিজ্ঞেস করল, " দাদু, অম্বালিকা তো বিকেল সাড়ে তিনটের সময় দেখা করার কথা, তাহলে এত সময় আগে পৌঁছেছিলেন কেন ? এত সকাল-- সকাল এসেছিলেন কেন ?" আশির্বাদ বলল, " গাড়ি-- ঘোড়ার অসুবিধের জন্য যদি বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে না পৌঁছতে পারি, সেজন্য আগে এসে পৌঁছেছি । কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাইনি ।"
কলম, কবিতা তোমার কালিতে
বৃষ্টি আসতে পারে, এই ভেবে আশির্বাদ ও সাধন ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিয়ে আসনে বসে ছিল । সাধন বলল, " দাদু,অম্বালিকার সাথে আপনার প্রেমের কথা বলা যাবে কি ?" আশির্বাদ এতদিন তার প্রেমের কথা কাউকে খুলে বলেনি । কিন্তু সাধনকে আশির্বাদ জানাল, "হ্যাঁ, অবশ্যই বলা যাবে।"
আশির্বাদ বলতে লাগল, " আমি ও অম্বালিকা দু'জনেই বাংলাদেশের বগুড়া জেলার সান্তাহার শহরে 'ব্রাইট ফিউচার' নামে চাকরির এক কোচিং সেন্টারে কোচিং নিতাম । কোচিং সেন্টারটি ছিল দোতলা । অম্বালিকা আসত টপ, শার্ট, জিনস পরে । অম্বালিকাকে এক মুহূর্ত দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল আমার । অম্বালিকাকে লুকিয়ে-- লুকিয়ে দেখতাম । মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, যার সাহায্যে তারা বা'দিক, ডানদিক তো বটেই পেছনে হলেও বুঝতে পারে তাদের কেউ দেখছে । অম্বালিকা বুঝতে পারত, তাকে একটা ছেলে দূর থেকে গোপনে-- গোপনে দেখে । পরে অম্বালিকার কাছে শুনেছিলাম, আমাকে প্রথম দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল অম্বালিকার । আমার স্মার্ট, ফর্সা, লম্বা, সুন্দর চেহারা মুগ্ধ করেছিল অম্বালিকাকে । অম্বালিকা সবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল আর আমার ভর্তি হওয়া বেশ কিছুদিন হয়ে গিয়েছিল ।
আমার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল । চোখের সামনে শুধু অম্বালিকা । না, না । কেউ বলার আগে তাকে বলতেই হবে আমার মনের কথা। বলতেই হবে, অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মনের গভীর থেকে ভালোবাসি ।
আমি ঠিক করেছিলাম, অম্বালিকা যখন একা থাকবে ,তখন গিয়ে বলব আমার মনের কথা । অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্রের দোতলা বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে একটা খবরের কাগজ দেখছিল । আমি বাথরুমে ঢুকেছিলাম । বাথরুমের ভেতর একটা গোটা-- সিগারেট খেয়েছিলাম । তারপর বুকভরা-- শ্বাস নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম । সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম অম্বালিকার দিকে । অম্বালিকার সামনে আসতেই কী যে হয়ে গিয়েছিল ! সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম ! কী বলব,কী করব খুঁজে পাচ্ছিলাম না । অম্বালিকা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, " কিছু বলবেন ?" আমি তোতলাতে শুরু করেছিলাম, "না, মানে ইয়ে,আজ কত তারিখ ?" অম্বালিকা চোখ বড়-- বড় করে বলেছিল, " আমি কী ক্যালেন্ডার, নাকি পঞ্জিকা ? বাড়িতে ক্যালেন্ডার নেই ? বাড়িতে গিয়ে ক্যালেন্ডার দেখুন, যান ।" আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়েছিলাম । কী হলো ! এমন হলো কেন ! আমি কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।
অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছিল । আমি দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম । মনে --মনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম । আমি এগিয়ে অম্বালিকার কাছে যেতেই আবার সব গোলমাল পাকিয়ে গিয়েছিল । বেলুনের যেমন ফুস করে হাওয়া বের হয়ে চুপসে যায় আমার বুকের ভেতরটা ঠিক, তেমনই হয়েছিল । আমি কিছু বলতে পারিনি । অম্বালিকা বলেছিল, " কী ব্যাপার ? আমার সামনে অমন ঘুরঘুর করছেন কেন ?" আমি তাল হারিয়ে ফেলেছিলাম । বলেছিলাম, " মানে ইয়ে, আচ্ছা, আগামিকাল কি এই কোচিং কেন্দ্র বন্ধ ?" অম্বালিকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, " আচ্ছা, আমার মুখ দেখে কী মনে হচ্ছে, আমি এই কোচিং কেন্দ্রের প্রিন্সিপাল ? কোচিং কেন্দ্র খোলা না বন্ধ থাকবে, সেটা প্রিন্সিপালকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, যান ।" অদ্ভুত ব্যাপার ! এমন হচ্ছে কেন ! আমি ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না । বন্ধু আয়ুষ্মানকে খুলে বলেছিলাম সব কথা । আয়ুষ্মান প্রেম করত । সে বলেছিল, " শোন বন্ধু, শুধু তুই কেন, অনেক বড়--বড় বাঘও মেয়েদের সামনে গিয়ে ভেড়া হয়ে যায় । তোর যেমন অবস্থা, তেমন আমারও হয়েছিল। তবে কোনওমতেই হাল ছাড়লে চলবে না, মনোবল হারালে চলবে না ।"
আমার হাতে সরু রবার দিয়ে প্যাঁচানো কিছু কাগজ ছিল । অম্বালিকার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম আমি । সে বারও আমার মুখ থেকে কোনও কথা বের হয়নি । উপরন্তু আমার হাতে থাকা কাগজ-- প্যাঁচানো-- সরু ------রবারটা ভয়ে আমার হাতের টান খেতে--খেতে ফটাশ করে ছিঁড়ে গিয়েছিল । অম্বালিকা বলেছিল, " কী ব্যাপার ? এখানে কেন ?" আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, "আচ্ছা, আপনার কাছে কি সরু রবার হবে ?"
অম্বালিকা বলেছিল, "কেন ? চুল বাঁধবেন বুঝি ?" আমি খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম । বলেছিলাম , " না, মানে ইয়ে,,,,,,,, " কথা সম্পূর্ণ করতে পারিনি । দ্রুত পালিয়ে এসেছিলাম আমি ।
আয়ুষ্মানকে গিয়ে বলেছিলাম , " ধুর ! ধুর ! আমার দ্বারা এসব হবে না । আমাকে একশো কেজি ওজন তুলতে বল, তা আমি তুলতে পারব, কিন্তু আমি এসব বলতে পারব না ।"
আমি কোচিং কেন্দ্রের একদিকে একা-- একা বসে একটা সিনেমার পত্রিকা ঘাটছিলাম । অম্বালিকা এগিয়ে এসেছিল আমার দিকে । আমার কাছে এসে বলেছিল, " কী করছেন ?" আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম । কোনওমতে বলেছিলাম, " একটা সিনেমার পত্রিকা দেখছিলাম ।"
অম্বালিকা বলেছিল, " একটা লাল-- কালির কলম হবে ? দরকার আছে ।" আমার ব্যাগের মধ্যে একটা লাল--কলম ছিল । আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল । পড়িমরি করে ব্যাগের ভেতর থেকে আমি লাল--কালির কলম বের করে দিয়েছিলাম । কলম হাতে নিয়ে অম্বালিকা বলেছিল, " এই যে শুনুন, এই সব সিনেমার পত্রিকা না ঘেঁটে সেই সময়টা অন্য কাজে দিলে জীবনে কিছু হবে ।" অম্বালিকা চলে গিয়েছিল ।
দু'দিন পরের ঘটনা । কোচিং সেন্টারে ভেতর আমার হাতে একটা সিনেমার পত্রিকা ছিল । পত্রিকাটা আমার ছিল না । পত্রিকাটি ছিল আয়ুষ্মানের । আমাকে কিনতে দিয়েছিল । পত্রিকাটি আমি খুলে দেখিনি । তখনও অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্রে আসেনি । বন্ধু আয়ুষ্মানের জন্য পত্রিকাটি আমার ব্যাগের মধ্যে ভরতে যাচ্ছিলাম, তখনই অম্বালিকা এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, " এই যে শুনুন, আপনি যদি নায়ক হতে চান কিংবা অভিনয় জগতে যেতে চান, তাহলে ঠিক আছে । তা না হলে সিনেমার পত্রিকা না পড়ে সাধারন জ্ঞানের বই পড়ুন, কাজে দেবে । এই নিন আপনার লাল--কলম ।" আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম অম্বালিকার মুখের দিকে । অম্বালিকা কলম ফেরত দিয়ে সিঁড়ি ধরে চলে যাচ্ছিল । কিছুটা দূরে গিয়ে অম্বালিকা পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার দিকে একটা হাসি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল । আমার মনে গিটার বেজে উঠেছিল । মেয়েদের মুখের 'হাসি' বহু,,,, বহু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । আমারও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল । আমি জোরে বলে উঠেছিলাম, " অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি । আই লাভ ইউ অম্বালিকা ।" অম্বালিকা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার দিকে আবার একটা হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিল । ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি ।
আমি আর অম্বালিকা প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । গভীর প্রেম । দু'জনে দু'জনকে ছাড়া থাকতে পারতাম না । প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল আমাদের দু'জনের বাড়িতে । আমার বাবা--মা মারা গিয়েছিলেন । আমি ছিলাম একমাত্র সন্তান । আমার পিসির বাড়িতে থাকতাম । আমার পিসি রাজি থাকলেও অম্বালিকার বাবা--মা রাজি ছিলেন না ।
একদিন অম্বালিকা জানিয়েছিল, "আশির্বাদ, আমাকে না জানিয়ে আমার বাবা--মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে । পাত্র সরকারি চাকরি করে । আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না । আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই ।"
আমি বলেছিলাম, " অম্বালিকা, আমি কোনও কাজ করি না । আমি বেকার । তোমাকে খুব ভালোবাসি । আমি চাই না তুমি আমাকে বিয়ে করে কষ্ট পাও । আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বলেই তোমাকে সুখী দেখতে চাই । তুমি তোমার বাবা--মার পাত্রটিকে বিয়ে করো ।" অম্বালিকা বলেছিল, " আমি তোমার জন্য দুঃখ,কষ্ট, যন্ত্রণা সব সহ্য করতে রাজি ।" আমি জানিয়েছিলাম, " অম্বালিকা, তুমি আমার সাথে ঘর বেঁধে কষ্ট পেলে আমার ভালোবাসাকে অশ্রদ্ধা করা হবে ,আমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা হবে । অম্বালিকা, তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি তোমার বাবা--মা'র পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করো ।"
অম্বালিকা তার বাবা--মা'র পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিল । আমাকে দেখে অম্বালিকার সংসার করতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সেজন্য আমি বিয়ের রাতেই গোপনভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলাম । আর বাংলাদেশে ফিরে যাইনি । ভারতে এসে প্রথমে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অবশেষে ডালখোলার 'আপন জন' অনাথ আশ্রমে এসে আমার মনটা থিতু হয়েছিল । পাকাপাকিভাবে এই আশ্রমেই থেকে যাই আমি ।
এসো গো কাছে এসো
সাড়ে তিনটে বাজতে তিরিশ মিনিট বাকি ।
আশির্বাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গেল । জোরে -- জোরে চলতে লাগল হৃদপিন্ড । এমননিতে মানুষের হৃদস্পন্দন মিনিটে বাহাত্তর বার । কিন্তু মাপলে বোঝা যেত, আশির্বাদের হৃদস্পন্দন একশো পার হয়ে গিয়েছে । কোনও মতেই বুকের ঢিপঢিপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না । আশির্বাদ নিয়মিত ব্যায়াম করে, প্রাণায়াম করে , তবু হৃদপিন্ডের জোরে চলাকে আটকাতে পারছিল না ।
নিচু স্বরে ধীরে--ধীরে কান্না চলছিল । আশির্বাদ তার ঘড়ি দেখল । সাড়ে তিনটে বেজে গেল । অম্বালিকার দেখা নেই । হাহাকার করে উঠল আশির্বাদের মন । তার আর সহ্য হলো না । সে বলল, "সাধন, যা তো । একবার ওপারে জোরে ডেকে--ডেকে অম্বালিকার খোঁজ করে আয় ।"
সাধন কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে জোরে --জোরে ডেকে উঠল, "ওপারে অম্বালিকা নামে কেউ আছেন ?" কোনও উত্তর এল না । সাধন আবার বলল, " অম্বালিকা নামে যদি কেউ এসে থাকেন, তাহলে এখানে আসবেন । আশির্বাদ দেখা করতে এসেছে ।" কোনও সাড়াশব্দ নেই । সাধন ফিরে এসে বলল, "না দাদু, অম্বালিকা আসেনি ।" আশির্বাদ মুষড়ে পড়ল । দুমড়ে মুচড়ে গেল তার মন । বিকেল চারটে বাজল । একটি ছেলে এসে বলল, "এখানে আশির্বাদ নামে কেউ আছে ? অম্বালিকা দেখা করতে এসেছে ।"
আশির্বাদ পড়িমরি করে উঠে দাঁড়াল । ছাতাটা গুটিয়ে নিয়ে বলল, " আমিই আশির্বাদ । কোথায় অম্বালিকা ? কোথায় ?" ছেলেটি পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে চলল । আশির্বাদ ছাতাটি ব্যাগে ঢুকিয়ে লাঠি নিয়ে সাধনের হাত ধরে ঠকঠক করে ছেলেটির পেছন--পেছন যেতে লাগল । ছেলেটি আশির্বাদকে কাঁটাতারের বেড়ার কাছাকাছি নিয়ে গেল । আশির্বাদ বলল, "কই, অম্বালিকা ? কই ?" ছেলেটি ওপারে এক হাতে লাঠি ধরে অন্য হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলল, "ওই যে অম্বালিকা ।" এরপর ছেলেটি আশির্বাদকে দেখিয়ে বৃদ্ধাটিকে বলল, " দিদিমা, এই যে আশির্বাদ ।" আশির্বাদ অম্বালিকাকে দেখল । অম্বালিকাও আশির্বাদকে দেখল । আশির্বাদের মুখের ভাষা হারিয়ে গেল । এত বছর পর অম্বালিকাকে দেখে মনটা ভরে গেল তার । এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অম্বালিকার দিকে । আশির্বাদের মনে পড়ল, অম্বালিকা তার বউ হয়ে রিকশা করে সারাদিন ঘুরেছিল । একদিন একটি রিকশা দেখে অম্বালিকা বলেছিল, " আশির্বাদ, আমার মনে হয়, রিকশার আবিষ্কারক বোধ হয় প্রেমিক--প্রেমিকা কিংবা স্বামী--স্ত্রীর কথা ভেবে দু'--আসনের রিকশার সৃষ্টি করেছিল ।" অম্বালিকা আরও বলেছিল, " জানো আশির্বাদ, কোনও যুবক--যুবতী রিকশায় পাশাপাশি বসে রিকশার হুডটি মাথার ওপর তুলে দিলে মনে হয়, যুবকটির বিয়ে করা নতুন বউ লজ্জায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে রয়েছে ।" সেদিন রিকশা ভাড়া করে আশির্বাদ ও অম্বালিকা পাশাপাশি বসে রিকশার হুড মাথার ওপর তুলে অম্বালিকা নতুন বউ হয়ে সমস্ত সান্তাহার শহরটা ঘুরেছিল ।
যে--লাঠিতে লোকে পথ চলে
আশির্বাদ এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া আঁকড়ে ধরল । কাছে থেকে প্রাণ ভরে দেখতে থাকল অম্বালিকাকে । বহু বছর পর দেখা হলেও অম্বালিকাকে চিনতে অসুবিধে হলো না আশির্বাদের । আশির্বাদের দু'চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়তে লাগল । অম্বালিকার চোখে চশমা । চশমার নিচ দিয়ে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল অম্বালিকার ।
আশির্বাদ বলল, "অম্বালিকা, তুমি এত দেরি করলে কেন ?"
অম্বালিকা বলল, " আমাদের নিজস্ব চার চাকা গাড়ির চাকা পরীক্ষা করে গাড়িতে উঠেছিলাম । দেখেছিলাম, ভালো চাকা । কিন্তু রাস্তায় চাকার মধ্যে কাঁটা ঢোকায় চাকা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তাই আসতে দেরি হলো ।
আশির্বাদ বলল, " অম্বালিকা, তুমি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ ।"
ওপার থেকে অম্বালিকা বলে উঠল, " আশির্বাদ, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি । অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি । একটিবার তোমাকে আমি দেখতে এসেছি । "
বহুদিন পর অম্বালিকার মধুর কন্ঠস্বর শুনে আশির্বাদের হৃদয় জুড়িয়ে গেল । আশির্বাদ মনে --মনে বলে উঠল, "আহ, কি মিষ্টি কন্ঠস্বর !
আশির্বাদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল । বুকের হাড় পাঁজর সব মড়মড় ভেঙে গেল । তোলপাড় শুরু হয়ে গেল দেহের মধ্যে । শরীরের ভেতর উথাল পাথাল আরম্ভ হয়ে গেল । আশির্বাদ গায়ের সব শক্তি দিয়ে বলে উঠল, "অম্বালিকা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি । খুব ভালোবাসি ।" ওপার থেকে অম্বালিকা জোরে-- জোরে বলে উঠল, "আশির্বাদ, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি । খুব ভালোবাসি ।"
আশির্বাদ ও অম্বালিকার দু'চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগল যেন দু'জনের চোখে হড়পা বান এসেছে । অম্বালিকা বা'হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠিটি সোজা ভাবে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে প্রবেশ করাল । এদিক থেকে আশির্বাদও বা'হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠি সোজা করে কাঁটাতারের ভেতরে প্রবেশ করাল । দু'টি লাঠির মাথা কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে সোজা ভাবে একে অপরকে স্পর্শ করল । পরস্পরকে স্পর্শ করে সোজা রূপে রইল দু'টি লাঠি । জুড়ে থাকা দুটি লাঠির মধ্যে দিয়ে ওপারের অম্বালিকার ছোঁয়া আশির্বাদের দেহে আবার এপারের আশির্বাদের স্পর্শ অম্বালিকার শরীরে প্রবাহিত হতে লাগল । আশির্বাদের দেহে শক্তি চলে এল । দেহের প্রতিটি কোষ সতেজ হয়ে উঠল । মাংস পেশি সজীব হয়ে উঠল । চনমন করে উঠল মন । আশির্বাদ অম্বালিকার সোজা ভাবে থাকা লাঠির ওপর তার লাঠিটি সোজা করে রেখে অম্বালিকার লাঠির অনেক--অনেকটা জায়গা স্পর্শ করাল ।
আকাশে পাখিরা উড়ছিল । মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল । গাছের পাতাগুলো নড়ছিল এদিক--ওদিক । আকাশে মেঘ ভেসে চলছিল । আশির্বাদের লাঠি ও অম্বালিকার লাঠি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রইল অনেক ,,,, অনেক সময় ।
এরপর অম্বালিকা তার লাঠির ওপর আশির্বাদের লাঠি নিয়ে লাঠি ছুঁয়ে থাকল বহু সময় । বহু---বহু-- বহু সময় ।
আশির্বাদ জিজ্ঞেস করল, " অম্বালিকা , তোমার সাথে কে এসেছে ?"
অম্বালিকা জানাল, " আমার সাথে আমার স্বামী এসেছে । সে দূরে গাড়িতে বসে রয়েছে । আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ।"
দু'বাহুর টুটো না বাঁধন
আশির্বাদ ও অম্বালিকা তাদের লাঠি দুটো তির্যকভাবে ওপরের দিকে তুলল । দুটো লাঠি পরস্পরকে স্পর্শ করল । তারপর দু'টি লাঠি একে অপরকে জড়িয়ে থাকল অনেকটা সময় ।
সীমান্তরক্ষীরা জানাল, "সময় শেষ । আর এখানে থাকা যাবে না ।" আশির্বাদ ও অম্বালিকা লাঠি স্পর্শ করে একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে রইল । কোনও দিকে তাদের খেয়াল নেই । কোনও হুঁশ নেই ওদের । সাধন বলল, " দাদু, চলুন সময় শেষ হয়ে গেছে ।" ভ্রুক্ষেপ নেই আশির্বাদের । সাধন জানাল, " দাদু, এখন না গেলে ডালখোলা যাওয়ার বাস পাবেন না ।" আশির্বাদ কোনও উত্তর দিল না । সাধন বলল, " দাদু, আমি জানলাম, মেলার নিয়মকানুন না মানলে মেলায় আর আসা যাবে না ।"
আশির্বাদ লাঠি সরিয়ে নিল । অম্বালিকা লাঠি টেনে নিল । লাঠি দুটো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে--সাথে ওরা দু'জনে জোরে--জোরে কেঁদে উঠল । হাউ--হাউ করে কাঁদতে লাগল । মেলায় আসা অন্যান্য লোকজনের কান্নার সঙ্গে আশির্বাদ আর অম্বালিকার কান্নাও জুড়ে গেল । চারিদিকে শুধু কান্না আর কান্না। কাঁদাকাঁদির মেলা কান্নাতে ভরে উঠল ।
ঘরে ফেরা সন্ধেবেলায়
সন্ধে হয়ে এসেছে । ঘরে ফিরতে হবে । লাঠি নিয়ে আশির্বাদ চলতে লাগল । সাধন আশির্বাদকে ধরতে গেল । আশির্বাদ বলল, "না । আমাকে ধরতে হবে না । আমার মাথা ঘোরা, শরীর দুর্বলতা সেরে গিয়েছে ।" আশির্বাদ একাই লাঠিতে ভর করে ঠকঠক করে চলতে লাগল । একা--একা লাঠি হাতে ঠকঠক করে অপরের সহায়তা ছাড়া চলতে চলতে আশির্বাদ বুঝতে পারল, লাঠি মানুষকে হাঁটতে এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করা ছাড়াও মানুষকে অসীম সুখ দেয়, অপার আনন্দও দেয় । পেছনে তখনও অনেক লোকের সমবেত কান্না চলছিল । কাঁদাকাঁদির মেলা চলছিল ।
সাধন আশির্বাদের হাত ধরে টোটোতে ওঠাতে গেলে আশির্বাদ সাধনের সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করে একা--একা টোটোতে গিয়ে উঠল । সাধন আশির্বাদের পাশে গিয়ে বসল । সন্ধে বেলায় অম্বালিকাকেও ঘরে ফিরতে হবে । ওপারে অম্বালিকা একা তাদের গাড়িতে চালকের আসনে বসা স্বামীর পাশে গিয়ে বসল । গাড়ির কাচ তুলে লাঠি বের করে লাঠি উঁচিয়ে অম্বালিকা আশির্বাদের দিকে তার লাঠিটি এদিক--ওদিক নাড়াতে লাগল । মনে --মনে বলল, " আশির্বাদ, আমার ক্যানসার হয়েছে । ডাক্তার বলেছে, আমি আর তিন মাস বাঁচব । পরের বছর আর দেখা হবে না । আর কোনও দিন দেখা হবে না । বাই--বাই ।"
সাধনের পাশে বসা আশির্বাদ লাঠিটি উঁচু করে অম্বালিকার উদ্দেশ্যে লাঠিটি এপাশ--ওপাশ নাড়াতে লাগল। মনে--মনে বলল, " অম্বালিকা, পরের বছর আবার দেখা হবে এই মাকড়হাটের মেলায়। টা-- টা।"
গোলোকেশ্বর সরকার
দক্ষিন দিনাজপুর
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
-
গল্প//উপন্যাস
-
28-10-2022
-
-