অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
বাঁশের সাঁকো - গোলোকেশ্বর সরকার

যাত্রী সে যে  ওরে
     হেমতাবাদ  বাসস্ট্যান্ড থেকে  টোটো চলছিল পকেট--রুটের রাস্তা ধরে । পাকা রাস্তা । রাস্তার অবস্থা ভালো । টোটো চলছিল  গড়গড় করে, মসৃনভাবে । তেমন ঝাঁকুনি হচ্ছিল না । টোটোতে বৃদ্ধ আশির্বাদ  ও  যুবক সাধন । পেছনের  আসনে আশির্বাদ ও সাধন দু'জন পাশাপাশি বসে । সাধন একহাত দিয়ে   আশির্বাদকে শক্ত করে ধরেছিল  ।  টোটোতে ওঠার সময় আশির্বাদ টোটোর তিনটে চাকা  বেশ  করে পরখ করে  টোটো চালককে জিজ্ঞেস করেছিল, চাকাগুলো ভালো আছে তো ?" 
টোটো চালক বলেছিল," হ্যাঁ, চাকাগুলো একদম নতুন ।  রাস্তা ভালো, চাকা নতুন । তাই  রাস্তার মাঝে চাকা ফুটো হয়ে যাওয়া  বা  ফেটে যাওয়ার  সম্ভাবনা খুব কম ।" আশির্বাদের টোটোটা পছন্দ হয়েছিল ।  সাধনের হাত ধরে  টোটোটিতে উঠেছিল বৃদ্ধ আশির্বাদ ।
     আশির্বাদের বয়স পঁয়ষট্টি বছর । অবিবাহিত ।   গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা ।   ' আপন জন  '  নামে একটি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত । আশ্রমই তার  ঘর,  আশ্রমই তার  ঠিকানা ।  আশ্রমের অনাথ  বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখায় । নিয়মিত পরিচর্যা করে, জল দিয়ে আশ্রমের  গাছগুলোকে  সবুজ রাখে ।
     সাধনের  বয়স ঊনিশ বছর ।  কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র । প্রেম করে ।  আশির্বাদের  কাঁধে একটি ব্যাগ । হাতে একটি  ভর দিয়ে চলার  লাঠি ।  কয়েক বছর ধরে লাঠি ছাড়া আশির্বাদ হাঁটতে পারে না ।
     আশির্বাদ একটু হেলে টোটোর সামনের চাকা  এবং   এদিক--ওদিক  বসে  পেছনের চাকা দুটো  ভালোভাবে  লক্ষ করছিল । চাকার দিকে তাকিয়ে  আশির্বাদ দেখছিল,  চাকা কীভাবে  তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছিল । নজর রাখছিল, কীভাবে তিনটে  চাকা তাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের গন্তব্যস্থানের দিকে পৌঁছে দিচ্ছিল । আশির্বাদ আসনের মাঝে  স্থির হয়ে বসে  বলল, " সাধন, বলতে পারবি  চাকার জন্ম হয়েছিল কেন ?" 
সাধন কলেজ পড়ে । তবে চাকা সম্পর্কে তার তেমন জানা ছিল না ।  সাধন উত্তর দিল, "না ।"
আশির্বাদ জানাল, "বহু বছর আগে কোনও কিছু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল । কোনও জিনিস এক স্থান থেকে অন্য স্থানে  টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাকার জন্ম হয়েছিল ।"
সাধন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, " দাদু,  কী দিয়ে প্রথম চাকা তৈরি হয়েছিল ?"
আশির্বাদ বলল, " কাঠের গুঁড়ির চাকতি দিয়ে প্রথম চাকা বানানো হয়েছিল ।"
সাধন প্রশ্ন করল, " সেই পুরনো সময়ে মানুষের মনে চাকার ব্যাপারটা এসেছিল কীভাবে ?
আশির্বাদ উত্তর দিল, " সম্ভবত, পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়তে দেখে মানুষের মনে চাকার ধারণা এসেছিল ।"
     আশির্বাদ আবার বলল, " বুঝলি সাধন,  চাকা মানুষকে  এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় টেনে  নিয়ে যায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে চলে । যেমন, চাকা আমাদের ডালখোলা থেকে হেমতাবাদে নিয়ে এসেছে আবার হেমতাবাদ  থেকে মেলাতে নিয়ে চলেছে । চাকা নিজেই  আমাদের বহন করে নিয়ে চলেছে ।

ডাক দিয়েছে সে   
     টোটো চলছিল গ্রামের রাস্তা ধরে  গ্রামের মেলার উদ্দেশ্যে । যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ গাছপালা আর সবুজ শস্যক্ষেত ।   সবুজের সৌন্দর্যে মন তরতাজা  হয়ে উঠল আশির্বাদের ।
আশির্বাদ বলল, " জানিস সাধন,  ডাক্তারবাবুরা  বলেন, সবুজ রং  চোখের পক্ষে খুবই উপকারী ।  কিন্তু  শুধু চোখ নয়, সবুজ রং চোখের সাথে-- সাথে মনকেও ভালো রাখে ।  সবুজের সমারোহ দেখে সাধনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, "খুবই সুন্দর ! অপূর্ব !" 
     আশির্বাদ  শ্বাস টেনে  বুক ভরে গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস নিল । বলে উঠল, " কি আরাম ! কি প্রশান্তি !"   সাধনকে  বলল, " জানিস  সাধন, যে--গ্রামকে আমরা অবহেলা করি, এমন একদিন আসবে, যেদিন শহরের লোকেরা  গ্রামে ছুটে  আসবে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য , আসলের খোঁজে , খাঁটির সন্ধানে ।" 
আশির্বাদ  জিজ্ঞেস করল, "  সাধন, 'মেলা'  কথার মানে কি জানিস ?"
সাধন বলল, " হ্যাঁ ।  'মেলা'   শব্দের অর্থ মিলন । 
চাকা কিন্তু আপন মনে  তার কাজ ঠিক মতো  করে যাচ্ছিল । কর্তব্যে গাফিলতি ছিল না তার ।  নিজস্ব গতি নিয়ে  এগিয়ে চলছিল সামনের দিকে ।  লক্ষে স্থির  চাকা । 
আশির্বাদ প্রশ্ন করল, "  সাধন, গ্রামের মেলায় গিয়েছিস কখনও ?" 
সাধন জানাল, " ছোট বেলায় বাবা--মা'র হাত ধরে গ্রামের মেলায় গিয়েছি । বড় হয়ে গ্রামের মেলায় আর যাওয়া হয়নি ।  মেলা মানে একে অপরের সাথে প্রাণ খুলে মেশা ।  মেলা মানে শুধু খুশি  আর খুশি ,আনন্দ আর আনন্দ ।"
সাধন বলতেই  বলল, " গ্রামের মেলা  বছরে কোনও নির্দিষ্ট দিনে অথবা তিথিতে  হয়ে থাকে ।  গ্রাম্য মেলাতে থাকে  মাটির স্বাদ । গ্রামের  মেলা প্রকৃতির মাঝে  কোন ফাঁকা জায়গায়  কিংবা খেলার মাঠে বসে ।  কোথাও মেলা  সকাল থেকে বসে,  কোথাও দুপুর থেকে বসে ।  সাধারণত মেলা চলে রাত পর্যন্ত।  তবে দূরের লোকেরা সন্ধের  পরে বাড়ি ফিরতে  শুরু করে ।
সাধন প্রশ্ন করল, " দাদু,  মেলাতে আপনি কীজন্য যাচ্ছেন ?" 
আশির্বাদ বলল, "এই মেলাতে ' অম্বালিকা' আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে । লোক মারফৎ আমাকে এই  মেলাতে  ডেকে পাঠিয়েছে ।  তিরিশ বছর পর আমাদের  দেখা হবে ।"

পায় না দেখতে  দু'চোখ তাকে 
     টোটোর  তিনটে চাকা সম্মিলিতভাবে আশির্বাদ আর  সাধনকে এক জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করালো । টোটোর চাকাগুলো এক জায়গায় স্থির হয়ে স্বস্তির শ্বাস  নিতে শুরু করল । যে--কর্তব্য তাদের ওপর ছিল, তা তারা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছে ।  
টোটোওয়ালা বলল, " দাদু,  আপনার জায়গা এসে গেছে ।" আশির্বাদ বলল, " জানি । এই জায়গা আমার  চেনা । সাত বছর আগে  একবার  বন্ধুর সাথে এখানে মেলা দেখতে এসেছিলাম ।" 
     টোটোতে বসে থেকে   আশির্বাদ  সাধনকে বলল, " সাধন, আমার ব্যাগটা নে আর  আমার  হাতটা একটু  ধর । আমি নামব ।"  সাধন এক হাতে ব্যাগটি নিল । অন্য হাতে  আশির্বাদের  বা'হাত ধরল ।  আশির্বাদ  ডান হাতে  লাঠিতে ভর করে টোটো থেকে নামল । ভাড়া মিটিয়ে দিলে টোটোওয়ালা চলে গেল । আশির্বাদ বলল, " সাধন, আমাকে ভালো করে ধরে রাখিস । নইলে পড়ে যেতে পারি ।"  সাধন শক্ত করে আশির্বাদের ডান হাত ধরে থাকল।  কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে  লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল  আশির্বাদ  ।  
     লাঠি হাতে ধরে  ঠকঠক করে  কিছুটা পথ চলার পর আশির্বাদ  একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল । আশির্বাদ বলল, " সাধন, এই   জায়গাতেই মেলাটি হয় ।"  সাধন বলল, "দাদু, এখানে তো নাগরদোলা, সার্কাস,পুতুলনাচ, ম্যাজিক প্রদর্শনী কোনওটাই  দেখছি না ।" আশির্বাদ বলল, "ওগুলো এই মেলায় বসে না । "     আশির্বাদ  ব্যাগ  থেকে দুটো আসন বের করল ।  আসন দু'টি মাটিতে  পাতল । সাধনকে  একটি আসন দেখিয়ে বলল, " সাধন, বোস ।   আসনটিতে  বোস ।"  
     সাধন আসনে বসল । অপর আসনে আশির্বাদ বসল ।  আশির্বাদ  ব্যাগের ভেতর থেকে  লাল ও  হলুদ রঙের  দুটো  ফোল্ডিং ছাতা   বের করল । হলুদ রঙের  ছাতাটি  সাধনকে দিয়ে লাল রঙের ছাতাটি  নিজে নিল । আশির্বাদ  লাল রঙের  ছাতাটি ফুটিয়ে  নিজের মাথায় দিল । সাধনকে ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিতে বলল ।    সাধন বলল, " দাদু, আমি কিন্তু এই মেলাতে কোনও দিনও আসিনি ।" সকাল  সাড়ে-- এগারোটা   বাজে ।  মাথার ওপর সূর্য । দু'জনে ছাতা মাথায় দিয়ে মাটিতে পাতা  আসনে বসে রইল  বিস্তীর্ণ মাঠের একধারে ।

তবু  শুরু হলো  মেলা  
     গতকাল আশির্বাদ সাধনকে  বলেছিল, "সাধন, আমি  আগামিকাল এখান থেকে অনেকদূর হেমতাবাদে এক মেলাতে যাব ।   কিন্তু শরীরটা আমার ভালো লাগছে না ।  দুর্বল লাগছে । মাঝে--মাঝে মাথা ঘুরছে ।  তুই যদি আমার সাথে যাস, আমার সঙ্গে থাকিস, আমাকে সাহায্য করিস,  তাহলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি । মেলাটিতে আমার যেতেই হবে ।"
     আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে সাধনের বাড়ি ।   সাধন জিজ্ঞেস করেছিল, কখন যাবেন ?" আশির্বাদ  বলেছিল, "  ভোরবেলা  যাব, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব । তোর যাতায়াত, খাওয়া--দাওয়া সমস্ত খরচ আমি দেব । গ্রামের মেলা ।"  
     সাধন আশির্বাদের কথা ফেলতে পারেনি ।
আশির্বাদ  সাধনের বাবা--মাকেও বলেছিল কথাটা । সাধনের বাবা--মাও সম্মতি জানিয়েছিল । মা  সাধনকে  বলেছিল," সাধন,  দাদুকে একা--একা ছাড়বি না । দাদু অসুস্থ । দাদুর সাথে--সাথে থাকবি । দাদুকে ধরে রাখবি ।"  সাধন বলেছিল, " ঠিক আছে মা ।" ভোরবেলা  সাধন  আশির্বাদের   আশ্রমে  এসে হাজির হয়েছিল । সাধন দেখেছিল,  আশির্বাদ    আগের থেকে তৈরি হয়ে বসেছিল ।  
     উত্তর দিনাজপুর জেলার  হেমতাবাদ মোড়  থেকে অনেকটা ভেতরে মেলাটি হয় । আশির্বাদ ও  সাধনের বাড়ি এই জেলারই  ডালখোলা নামে জায়গায় ।   ডালখোলা থেকে রায়গঞ্জ আবার    রায়গঞ্জ থেকে হেমতাবাদে বাসে করে আসতে সকাল  দশটা  বেজে গিয়েছিল ।  হেমতাবাদে হোটেলে দু'জনে  ভাত খেয়ে সকাল  সাড়ে  দশটায় মেলার উদ্দেশ্যে  টোটো  ধরেছিল ।
     সাধন ছাতা  মাথায় বসে থেকে চারদিকে তাকাল । দেখল, অনেকদূর পর্যন্ত কোনও বাড়িঘর নেই ।  ফাঁকা মাঠ । কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছে । সামনের দিকে কাঁটাতারের বেড়া । সাধন কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আশির্বাদ  বলল , "ওটা ভারত--বাংলাদেশ  কাঁটাতারের বেড়া । ওপারে বাংলাদেশ এপারে  ভারত ।"  সাধন জিজ্ঞেস করল, "দাদু,  মেলা কখন শুরু হবে ?" আশির্বাদ   বলল, " অনেকক্ষণ আগে মেলা  শুরু হয়ে গেছে  । প্রতিবছর আজকের দিনে মেলাটি হয় ।  ওই যে লোকগুলো ঘোরাঘুরি করছে, ওরা মেলারই লোক ।"     সাধন চারদিক তাকাল । তারপর  আশির্বাদকে বলল, "দাদু, এখানে তো  কোনও  মিষ্টির দোকান,  জিলিপির দোকান, মনোহারি দোকান, মাটির তৈরি জিনিসের দোকান, হাতের কাজের দোকান, বেলুনওয়ালা, বাঁশিওয়ালা  কোনও রকম কিছু  দেখতে পাচ্ছি না । তাহলে মেলা কই ?"
আশির্বাদ  উত্তর দিল, " এই মেলাতে ওসব কিছুই দেখা যায়  না ।  ওসব কিছু আসে না এখানকার মেলাতে  " 
সাধনের মাথায় কিছু ঢুকল না । সাধনের মাথা গুলিয়ে গেল ।   সাধন আর কোনও কথা  না বলে চুপ করে রইল ।
     একে-- একে অনেক লোক  আসতে লাগল ।  যুবক, যুবতী,  বিবাহিত ছেলেরা , বউরা ,পৌঢ়,পৌঢ়া, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা  সকলে এই জায়গায় এসে জমায়েত হতে লাগল । সাধন  দেখতে পেল,  কিছু সময়ের মধ্যে লোকে ভরে গেল ফাঁকা মাঠ ।   শয়ে শয়ে লোক ।  সাধন জিজ্ঞেস করল, " দাদু, এখানে এত লোক কেন জমায়েত হচ্ছে  ?"  আশির্বাদ   বলল, " এই সমস্ত লোক মেলার লোক । সব লোক এখানকার মেলাতে এসেছে । "  
সাধনের কোনও  কিছু বোধগম্য হলো  না । সাধন লক্ষ করল, কাঁটাতারের ওপারেও  অনেক লোক । সাধন বুঝল, এখানকার মেলাটা  খুব বড় ও বিখ্যাত  মেলা ।  তাই ওপারের লোকজনও এই মেলা দেখতে এসেছে ।
সাধন বলল, " দাদু, অম্বালিকার বয়স কত হবে?"
আশির্বাদ  বলল, " একষট্টি বছর ।"
"দেখতে কেমন ?"
"খুবই সুন্দর । গায়ের রং ফর্সা । ঘন কালো চুল  ,চোখ দুটো টানাটানা । মাঝারি উচ্চতা ।"
"ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করার কোনও সময় দিয়েছে কি ?"
" হ্যাঁ । ঠিক বিকেল সাড়ে তিনটে ।"

বৃষ্টি ঝরে  ঝমঝম 
     অল্প সময়ের মধ্যে মেঘে ঢেকে গেল আকাশ । কিছুক্ষণ আগে  যে--সূর্যের আলো  গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল, সেটা  উধাও হয়ে গেল ।  গুমোট আবহাওয়া ।  কেউ কেউ   বলতে লাগল, " বৃষ্টি আসবে বোধ হয় ।"
     সাধন দেখল,   মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত লোক একসঙ্গে জোরে কেঁদে  উঠল।  জোরে--জোরে কান্না ।  হাউ -- হাউ করে  কান্না  । কান্নার শব্দে  ভরে গেল সারা মাঠ । ভরে গেল চারদিক । আকাশে বাতাসে  শুধু কান্না শুধু কান্না । আশির্বাদও  কাঁদতে শুরু করল । দু'চোখ দিয়ে অজস্র ধারায়  জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার ।  কিছুক্ষণ পর সকলের  কান্নার তীব্রতা ধীরে--ধীরে কমে গেল । হেঁচকি তুলতে তুলতে  আশির্বাদের  কান্না  থেমে  গেল ।
     সাধন আশ্চর্য  হয়ে গেল ।   আশির্বাদকে  জিজ্ঞেস করল, " দাদু, সকলে  একসাথে  এমন কেঁদে উঠল কেন ? আপনি  অঝোরে কাঁদছিলেন কেন ?"
আশির্বাদ  বলল , "  মেলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে  গিয়েছে । এটা কাঁদাকাঁদির  মেলা ।  এই মেলায়  আসা লোকেরা তাদের  আত্মীয়-স্বজন-- প্রতিবেশি --বন্ধুদের দু'চোখ ভরে  দেখে আর  কাঁদতে থাকে । অনেক সময় ধরে চলে এই মেলা । প্রথমে কান্না ধীরে-- ধীরে হয়, তারপর কান্নার  শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে ।  একসময় সবাই খুব জোরে-- জোরে কাঁদতে শুরু করে ।"
আশির্বাদ সাধনকে  বলতে থাকল, " ওই যে কাঁটাতারের দেখছিস,  ওই বেড়ার  এপারে ভারত আর ওপারে  বাংলাদেশ  ।  ভারতের লোকেরা তাদের  বাংলাদেশের  আত্মীয়--স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধুদের  দেখে কাঁদতে থাকে  । আবার বাংলাদেশের লোকজন তাদের ভারতের   আত্মীয়,বন্ধু, পড়শিদের দেখে  অঝোর ধারায়   কান্না করে । কাঁটাতারের বেড়ার  এপারের ভারতের লোকজন আগে ওপারে বাংলাদেশে থাকত । ওপার থেকে  তারা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করে । দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় বছরের আজকের বিশেষ দিনে দু'পারের লোকজন  দু'পারের লোকজনকে দু'চোখ ভরে  দেখে  আর  কাঁদে ।  অজস্র ধারায় কাঁদে । শুধু কাঁদে, শুধু কাঁদে,,,,,,,, "
সাধন  সামনের দিকে তাকাল । দেখল, লোকগুলো তখনও কাঁদছিল । নিচু স্বরে কাঁদছিল ।  সকলের চোখে জল । ঝরঝর করে জল  ঝরে পড়ছিল ।  
     সাধন  তার হাত--ঘড়ি দেখল । দেখল, দুপুর আড়াইটে  বাজে । আর এক ঘন্টা বাকি অম্বালিকা আসার ।
সাধন  আশির্বাদকে জিজ্ঞেস করল, "দাদু,  অম্বালিকা আপনার কে হন ?"  
আশির্বাদ  বলল, " তিরিশ বছর আগে অম্বালিকা আমার প্রেমিকা ছিল । আমরা একে অপরকে খুব  ভালোবাসতাম । এখন অম্বালিকার  স্বামী আছে,  সংসার আছে, ছেলে--মেয়ে আছে ।   তিরিশ  বছর আমাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না ।"
সাধন জিজ্ঞেস করল, " দাদু, অম্বালিকা  তো  বিকেল সাড়ে তিনটের সময় দেখা করার কথা, তাহলে এত সময় আগে  পৌঁছেছিলেন কেন ? এত সকাল-- সকাল এসেছিলেন কেন ?"  আশির্বাদ  বলল, " গাড়ি-- ঘোড়ার অসুবিধের জন্য যদি বিকেল  সাড়ে তিনটের  মধ্যে না পৌঁছতে পারি, সেজন্য আগে এসে পৌঁছেছি । কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাইনি ।"

কলম, কবিতা তোমার কালিতে 
     বৃষ্টি আসতে পারে, এই ভেবে আশির্বাদ ও সাধন ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিয়ে আসনে বসে ছিল ।  সাধন বলল, "   দাদু,অম্বালিকার সাথে আপনার প্রেমের কথা বলা যাবে কি ?" আশির্বাদ এতদিন তার প্রেমের কথা কাউকে খুলে বলেনি ।  কিন্তু  সাধনকে আশির্বাদ জানাল, "হ্যাঁ, অবশ্যই  বলা যাবে।" 
আশির্বাদ বলতে লাগল, " আমি  ও  অম্বালিকা  দু'জনেই বাংলাদেশের বগুড়া জেলার  সান্তাহার শহরে   'ব্রাইট ফিউচার'  নামে  চাকরির এক  কোচিং সেন্টারে কোচিং নিতাম । কোচিং সেন্টারটি ছিল  দোতলা ।  অম্বালিকা আসত  টপ, শার্ট, জিনস পরে । অম্বালিকাকে এক মুহূর্ত দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল আমার । অম্বালিকাকে  লুকিয়ে-- লুকিয়ে দেখতাম । মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, যার  সাহায্যে তারা বা'দিক, ডানদিক তো বটেই  পেছনে হলেও বুঝতে পারে তাদের কেউ দেখছে ।  অম্বালিকা বুঝতে পারত, তাকে একটা ছেলে দূর থেকে গোপনে-- গোপনে  দেখে । পরে অম্বালিকার কাছে শুনেছিলাম,  আমাকে প্রথম দেখেই   ভালো লেগে গিয়েছিল অম্বালিকার । আমার স্মার্ট, ফর্সা, লম্বা, সুন্দর চেহারা মুগ্ধ করেছিল অম্বালিকাকে ।  অম্বালিকা সবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল  আর  আমার  ভর্তি হওয়া বেশ কিছুদিন হয়ে গিয়েছিল । 
আমার  রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল ।  চোখের সামনে শুধু অম্বালিকা ।  না, না ।  কেউ বলার আগে তাকে  বলতেই হবে  আমার  মনের কথা। বলতেই হবে,  অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মনের গভীর থেকে ভালোবাসি । 
আমি  ঠিক করেছিলাম, অম্বালিকা যখন একা থাকবে ,তখন গিয়ে বলব  আমার মনের কথা । অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্রের দোতলা বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে একটা  খবরের কাগজ  দেখছিল । আমি  বাথরুমে ঢুকেছিলাম । বাথরুমের ভেতর  একটা গোটা-- সিগারেট খেয়েছিলাম ।  তারপর বুকভরা-- শ্বাস  নিয়ে  বেরিয়ে এসেছিলাম । সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম  অম্বালিকার  দিকে  ।  অম্বালিকার  সামনে আসতেই  কী যে হয়ে গিয়েছিল ! সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম  !  কী বলব,কী করব খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।  অম্বালিকা খবরের কাগজ  থেকে  মুখ তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, " কিছু বলবেন ?"   আমি  তোতলাতে শুরু করেছিলাম, "না, মানে ইয়ে,আজ কত তারিখ ?" অম্বালিকা  চোখ বড়-- বড় করে বলেছিল, " আমি কী ক্যালেন্ডার, নাকি পঞ্জিকা ?  বাড়িতে ক্যালেন্ডার নেই ? বাড়িতে গিয়ে ক্যালেন্ডার দেখুন, যান ।" আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়েছিলাম  । কী হলো ! এমন হলো কেন !   আমি  কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম  না ।  
     অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছিল ।  আমি  দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম ।  মনে --মনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম । আমি এগিয়ে অম্বালিকার কাছে যেতেই  আবার সব  গোলমাল পাকিয়ে গিয়েছিল ।  বেলুনের যেমন  ফুস করে হাওয়া বের হয়ে চুপসে যায় আমার  বুকের ভেতরটা ঠিক, তেমনই হয়েছিল  ।  আমি   কিছু বলতে পারিনি ।  অম্বালিকা বলেছিল, " কী ব্যাপার ?  আমার সামনে অমন ঘুরঘুর করছেন কেন ?"   আমি তাল  হারিয়ে ফেলেছিলাম । বলেছিলাম, " মানে ইয়ে, আচ্ছা, আগামিকাল কি  এই  কোচিং কেন্দ্র বন্ধ ?"  অম্বালিকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, "  আচ্ছা,  আমার  মুখ দেখে কী  মনে হচ্ছে, আমি এই  কোচিং কেন্দ্রের প্রিন্সিপাল ?  কোচিং  কেন্দ্র খোলা না বন্ধ থাকবে, সেটা প্রিন্সিপালকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, যান ।"   অদ্ভুত ব্যাপার ! এমন হচ্ছে কেন !  আমি  ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না । বন্ধু আয়ুষ্মানকে খুলে বলেছিলাম  সব কথা । আয়ুষ্মান প্রেম করত । সে বলেছিল, " শোন বন্ধু, শুধু তুই কেন, অনেক  বড়--বড়   বাঘও  মেয়েদের সামনে গিয়ে ভেড়া হয়ে যায় । তোর যেমন অবস্থা, তেমন আমারও  হয়েছিল। তবে কোনওমতেই হাল ছাড়লে চলবে না, মনোবল হারালে চলবে না ।"
     আমার  হাতে সরু রবার দিয়ে প্যাঁচানো কিছু কাগজ ছিল । অম্বালিকার  দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম আমি ।  সে বারও  আমার  মুখ  থেকে কোনও  কথা বের হয়নি । উপরন্তু  আমার  হাতে থাকা কাগজ-- প্যাঁচানো-- সরু ------রবারটা ভয়ে আমার  হাতের টান  খেতে--খেতে ফটাশ করে ছিঁড়ে গিয়েছিল । অম্বালিকা বলেছিল, " কী ব্যাপার ? এখানে কেন ?"  আমার  মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, "আচ্ছা, আপনার কাছে কি সরু রবার হবে ?"
অম্বালিকা বলেছিল, "কেন ? চুল বাঁধবেন বুঝি ?" আমি  খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম । বলেছিলাম , " না, মানে ইয়ে,,,,,,,,  "     কথা সম্পূর্ণ করতে পারিনি । দ্রুত পালিয়ে এসেছিলাম  আমি  ।
আয়ুষ্মানকে গিয়ে বলেছিলাম , " ধুর ! ধুর ! আমার দ্বারা এসব হবে না । আমাকে একশো কেজি ওজন তুলতে বল, তা আমি তুলতে পারব, কিন্তু আমি এসব বলতে পারব না ।"
     আমি কোচিং কেন্দ্রের  একদিকে একা-- একা বসে একটা  সিনেমার পত্রিকা ঘাটছিলাম । অম্বালিকা এগিয়ে  এসেছিল আমার  দিকে । আমার  কাছে এসে বলেছিল, " কী করছেন ?" আমি  থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম ।   কোনওমতে বলেছিলাম, "  একটা সিনেমার পত্রিকা দেখছিলাম ।" 
অম্বালিকা বলেছিল, " একটা লাল-- কালির কলম হবে ? দরকার আছে ।"     আমার ব্যাগের মধ্যে একটা লাল--কলম ছিল । আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল । পড়িমরি করে ব্যাগের  ভেতর থেকে আমি  লাল--কালির কলম বের করে দিয়েছিলাম । কলম হাতে নিয়ে অম্বালিকা বলেছিল, " এই যে শুনুন, এই সব সিনেমার পত্রিকা  না ঘেঁটে সেই সময়টা অন্য কাজে দিলে জীবনে কিছু হবে ।"  অম্বালিকা চলে গিয়েছিল ।
     দু'দিন পরের ঘটনা ।  কোচিং সেন্টারে ভেতর  আমার হাতে একটা সিনেমার পত্রিকা ছিল  ।  পত্রিকাটা আমার ছিল না । পত্রিকাটি ছিল আয়ুষ্মানের । আমাকে কিনতে দিয়েছিল । পত্রিকাটি  আমি খুলে দেখিনি । তখনও  অম্বালিকা  কোচিং  কেন্দ্রে আসেনি ।  বন্ধু  আয়ুষ্মানের জন্য  পত্রিকাটি  আমার ব্যাগের মধ্যে ভরতে যাচ্ছিলাম, তখনই   অম্বালিকা এসে  দাঁড়িয়ে বলেছিল, " এই যে শুনুন, আপনি যদি নায়ক হতে চান  কিংবা অভিনয় জগতে যেতে চান, তাহলে ঠিক আছে । তা না  হলে সিনেমার পত্রিকা না পড়ে সাধারন জ্ঞানের বই পড়ুন, কাজে দেবে ।  এই নিন আপনার লাল--কলম ।"   আমি  হাঁ  করে তাকিয়েছিলাম  অম্বালিকার মুখের দিকে ।  অম্বালিকা কলম ফেরত দিয়ে সিঁড়ি ধরে চলে যাচ্ছিল । কিছুটা দূরে গিয়ে অম্বালিকা পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার  দিকে একটা হাসি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল । আমার মনে  গিটার বেজে উঠেছিল ।  মেয়েদের মুখের 'হাসি'   বহু,,,, বহু  বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । আমারও  বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল ।  আমি   জোরে বলে উঠেছিলাম, "  অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি ।  আই লাভ ইউ অম্বালিকা ।"  অম্বালিকা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়ে  আমার দিকে আবার  একটা হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিল । ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরলে যেমন  আনন্দ হয়, তেমনই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম  আমি  ।
     আমি  আর অম্বালিকা প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম ।  গভীর প্রেম ।  দু'জনে দু'জনকে ছাড়া থাকতে পারতাম না ।  প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল আমাদের  দু'জনের বাড়িতে ।  আমার  বাবা--মা  মারা গিয়েছিলেন । আমি ছিলাম  একমাত্র সন্তান ।   আমার পিসির বাড়িতে থাকতাম  । আমার  পিসি রাজি থাকলেও অম্বালিকার বাবা--মা রাজি ছিলেন না ।
     একদিন অম্বালিকা জানিয়েছিল, "আশির্বাদ,  আমাকে না জানিয়ে আমার  বাবা--মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে । পাত্র সরকারি চাকরি করে । আমি  অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না  । আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই ।"
আমি   বলেছিলাম, " অম্বালিকা, আমি কোনও কাজ করি না । আমি বেকার ।   তোমাকে  খুব ভালোবাসি । আমি চাই না তুমি আমাকে বিয়ে করে কষ্ট পাও  । আমি তোমাকে  খুব ভালোবাসি বলেই তোমাকে সুখী দেখতে চাই । তুমি তোমার   বাবা--মার পাত্রটিকে বিয়ে করো ।"    অম্বালিকা বলেছিল, " আমি তোমার জন্য দুঃখ,কষ্ট, যন্ত্রণা সব   সহ্য করতে রাজি ।"    আমি   জানিয়েছিলাম, "  অম্বালিকা,  তুমি আমার সাথে ঘর বেঁধে  কষ্ট পেলে  আমার ভালোবাসাকে অশ্রদ্ধা করা হবে ,আমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা হবে ।  অম্বালিকা, তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি তোমার বাবা--মা'র পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করো ।"    
     অম্বালিকা  তার  বাবা--মা'র পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিল । আমাকে  দেখে  অম্বালিকার সংসার করতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সেজন্য আমি   বিয়ের রাতেই গোপনভাবে  বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলাম । আর বাংলাদেশে ফিরে যাইনি ।  ভারতে এসে প্রথমে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে  অবশেষে ডালখোলার  'আপন জন' অনাথ আশ্রমে এসে  আমার  মনটা থিতু হয়েছিল । পাকাপাকিভাবে এই  আশ্রমেই থেকে যাই আমি  ।  

এসো গো কাছে এসো 
     সাড়ে তিনটে  বাজতে  তিরিশ মিনিট বাকি । 
    আশির্বাদের  বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গেল । জোরে -- জোরে চলতে লাগল হৃদপিন্ড । এমননিতে মানুষের হৃদস্পন্দন মিনিটে বাহাত্তর বার । কিন্তু মাপলে বোঝা যেত, আশির্বাদের হৃদস্পন্দন একশো পার হয়ে গিয়েছে ।  কোনও মতেই বুকের ঢিপঢিপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না ।  আশির্বাদ  নিয়মিত ব্যায়াম করে, প্রাণায়াম করে , তবু  হৃদপিন্ডের জোরে চলাকে আটকাতে পারছিল না । 
     নিচু স্বরে ধীরে--ধীরে কান্না  চলছিল । আশির্বাদ তার  ঘড়ি দেখল । সাড়ে তিনটে বেজে গেল  । অম্বালিকার দেখা নেই । হাহাকার করে উঠল আশির্বাদের মন । তার  আর সহ্য  হলো না ।      সে  বলল, "সাধন,  যা তো ।  একবার ওপারে জোরে ডেকে--ডেকে অম্বালিকার খোঁজ করে আয় ।"
     সাধন কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে জোরে --জোরে ডেকে উঠল, "ওপারে অম্বালিকা নামে কেউ আছেন ?"  কোনও উত্তর এল না  ।   সাধন আবার বলল, " অম্বালিকা নামে যদি কেউ এসে থাকেন,  তাহলে এখানে আসবেন ।  আশির্বাদ  দেখা করতে এসেছে ।"   কোনও সাড়াশব্দ নেই । সাধন ফিরে এসে বলল, "না দাদু,  অম্বালিকা আসেনি ।"  আশির্বাদ মুষড়ে পড়ল । দুমড়ে মুচড়ে গেল তার মন ।  বিকেল চারটে বাজল  । একটি ছেলে এসে বলল, "এখানে আশির্বাদ নামে কেউ আছে ?  অম্বালিকা দেখা করতে এসেছে ।" 
     আশির্বাদ  পড়িমরি  করে উঠে দাঁড়াল । ছাতাটা গুটিয়ে নিয়ে বলল, " আমিই আশির্বাদ । কোথায় অম্বালিকা ? কোথায় ?"  ছেলেটি  পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে চলল । আশির্বাদ ছাতাটি ব্যাগে ঢুকিয়ে  লাঠি  নিয়ে সাধনের হাত ধরে ঠকঠক করে  ছেলেটির পেছন--পেছন যেতে লাগল । ছেলেটি আশির্বাদকে  কাঁটাতারের বেড়ার  কাছাকাছি নিয়ে গেল ।  আশির্বাদ বলল, "কই, অম্বালিকা ? কই ?" ছেলেটি ওপারে এক হাতে লাঠি ধরে অন্য হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে থাকা এক   বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলল, "ওই যে  অম্বালিকা ।" এরপর ছেলেটি আশির্বাদকে দেখিয়ে বৃদ্ধাটিকে বলল, " দিদিমা,  এই যে আশির্বাদ ।"   আশির্বাদ  অম্বালিকাকে  দেখল ।  অম্বালিকাও আশির্বাদকে দেখল ।   আশির্বাদের  মুখের ভাষা হারিয়ে গেল ।  এত বছর পর অম্বালিকাকে দেখে মনটা ভরে গেল  তার । এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অম্বালিকার দিকে ।   আশির্বাদের  মনে পড়ল, অম্বালিকা তার  বউ হয়ে রিকশা করে সারাদিন ঘুরেছিল ।   একদিন একটি  রিকশা দেখে  অম্বালিকা   বলেছিল, "  আশির্বাদ,  আমার মনে হয়, রিকশার আবিষ্কারক বোধ হয় প্রেমিক--প্রেমিকা কিংবা  স্বামী--স্ত্রীর কথা ভেবে   দু'--আসনের রিকশার সৃষ্টি করেছিল ।" অম্বালিকা আরও বলেছিল, " জানো আশির্বাদ, কোনও  যুবক--যুবতী  রিকশায় পাশাপাশি  বসে  রিকশার হুডটি মাথার ওপর তুলে দিলে  মনে হয়, যুবকটির  বিয়ে করা নতুন  বউ লজ্জায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে রয়েছে ।"  সেদিন  রিকশা ভাড়া করে আশির্বাদ ও অম্বালিকা পাশাপাশি বসে রিকশার হুড মাথার ওপর তুলে অম্বালিকা  নতুন বউ হয়ে  সমস্ত  সান্তাহার শহরটা ঘুরেছিল ।

যে--লাঠিতে লোকে  পথ চলে 
     আশির্বাদ এগিয়ে গিয়ে  হাত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া আঁকড়ে ধরল । কাছে থেকে   প্রাণ ভরে দেখতে থাকল অম্বালিকাকে ।  বহু বছর  পর দেখা হলেও অম্বালিকাকে চিনতে অসুবিধে হলো না আশির্বাদের । আশির্বাদের  দু'চোখ দিয়ে   ঝরঝর করে জল ঝরে পড়তে লাগল । অম্বালিকার চোখে চশমা ।  চশমার নিচ  দিয়ে   অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল অম্বালিকার ।
আশির্বাদ বলল, "অম্বালিকা, তুমি এত দেরি করলে কেন ?"
অম্বালিকা বলল, "  আমাদের নিজস্ব চার চাকা গাড়ির চাকা পরীক্ষা করে  গাড়িতে উঠেছিলাম । দেখেছিলাম, ভালো চাকা । কিন্তু  রাস্তায়   চাকার মধ্যে কাঁটা  ঢোকায় চাকা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তাই  আসতে  দেরি হলো ।
আশির্বাদ  বলল, " অম্বালিকা, তুমি  কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ ।" 
ওপার  থেকে  অম্বালিকা বলে উঠল, " আশির্বাদ, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি । অনেকদিন তোমার সাথে  দেখা হয়নি । একটিবার তোমাকে  আমি দেখতে এসেছি । "
বহুদিন পর অম্বালিকার মধুর  কন্ঠস্বর শুনে আশির্বাদের হৃদয়  জুড়িয়ে গেল ।  আশির্বাদ  মনে --মনে  বলে উঠল, "আহ, কি মিষ্টি কন্ঠস্বর !
     আশির্বাদের  বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল । বুকের হাড় পাঁজর সব মড়মড় ভেঙে গেল । তোলপাড় শুরু হয়ে গেল দেহের মধ্যে । শরীরের ভেতর উথাল পাথাল আরম্ভ হয়ে গেল । আশির্বাদ  গায়ের সব শক্তি দিয়ে বলে উঠল, "অম্বালিকা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি । খুব ভালোবাসি ।"  ওপার থেকে অম্বালিকা জোরে-- জোরে  বলে উঠল, "আশির্বাদ,  আমিও  তোমাকে খুব ভালোবাসি । খুব ভালোবাসি ।" 
     আশির্বাদ  ও অম্বালিকার  দু'চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগল যেন দু'জনের চোখে হড়পা  বান এসেছে ।   অম্বালিকা বা'হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠিটি  সোজা ভাবে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে প্রবেশ করাল ।  এদিক থেকে  আশির্বাদও বা'হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠি সোজা করে   কাঁটাতারের  ভেতরে প্রবেশ করাল ।  দু'টি লাঠির মাথা কাঁটাতারের  বেড়ার মাঝখানে সোজা ভাবে একে অপরকে  স্পর্শ করল । পরস্পরকে  স্পর্শ করে সোজা রূপে  রইল দু'টি লাঠি  ।  জুড়ে থাকা দুটি লাঠির  মধ্যে দিয়ে ওপারের অম্বালিকার ছোঁয়া  আশির্বাদের  দেহে  আবার এপারের  আশির্বাদের  স্পর্শ  অম্বালিকার শরীরে প্রবাহিত হতে লাগল  ।  আশির্বাদের  দেহে শক্তি চলে এল ।  দেহের প্রতিটি কোষ সতেজ হয়ে উঠল । মাংস পেশি সজীব হয়ে উঠল । চনমন করে উঠল মন ।  আশির্বাদ  অম্বালিকার সোজা ভাবে থাকা  লাঠির ওপর   তার লাঠিটি  সোজা করে রেখে অম্বালিকার লাঠির অনেক--অনেকটা জায়গা স্পর্শ করাল । 
আকাশে পাখিরা উড়ছিল ।  মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল । গাছের পাতাগুলো নড়ছিল এদিক--ওদিক । আকাশে মেঘ ভেসে চলছিল ।   আশির্বাদের লাঠি ও অম্বালিকার লাঠি পরস্পরকে  জড়িয়ে ধরে  রইল অনেক ,,,, অনেক সময় । 
এরপর  অম্বালিকা  তার  লাঠির ওপর  আশির্বাদের  লাঠি  নিয়ে লাঠি ছুঁয়ে থাকল বহু সময় । বহু---বহু-- বহু সময় । 
আশির্বাদ  জিজ্ঞেস করল, " অম্বালিকা , তোমার সাথে কে এসেছে ?" 
অম্বালিকা জানাল, " আমার সাথে আমার স্বামী এসেছে । সে  দূরে  গাড়িতে বসে  রয়েছে । আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ।"

দু'বাহুর টুটো  না  বাঁধন
     আশির্বাদ ও অম্বালিকা তাদের লাঠি  দুটো তির্যকভাবে  ওপরের দিকে তুলল  । দুটো লাঠি পরস্পরকে স্পর্শ করল  । তারপর  দু'টি লাঠি একে অপরকে  জড়িয়ে থাকল অনেকটা সময় ।
     সীমান্তরক্ষীরা জানাল, "সময় শেষ । আর এখানে থাকা যাবে না ।" আশির্বাদ ও অম্বালিকা  লাঠি স্পর্শ করে একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে রইল ।  কোনও দিকে  তাদের খেয়াল নেই ।  কোনও হুঁশ নেই ওদের ।   সাধন বলল, " দাদু, চলুন সময় শেষ হয়ে গেছে ।"  ভ্রুক্ষেপ নেই আশির্বাদের  ।  সাধন জানাল, " দাদু, এখন না গেলে ডালখোলা  যাওয়ার বাস পাবেন না ।" আশির্বাদ কোনও  উত্তর দিল না । সাধন  বলল, " দাদু, আমি জানলাম, মেলার  নিয়মকানুন না মানলে মেলায় আর আসা যাবে না ।" 
     আশির্বাদ লাঠি সরিয়ে নিল ।  অম্বালিকা লাঠি টেনে নিল । লাঠি দুটো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে--সাথে  ওরা দু'জনে জোরে--জোরে  কেঁদে উঠল । হাউ--হাউ করে কাঁদতে লাগল ।  মেলায় আসা  অন্যান্য লোকজনের কান্নার সঙ্গে আশির্বাদ আর অম্বালিকার কান্নাও  জুড়ে গেল । চারিদিকে শুধু কান্না আর কান্না।   কাঁদাকাঁদির মেলা  কান্নাতে  ভরে উঠল  ।  

ঘরে ফেরা  সন্ধেবেলায়
     সন্ধে হয়ে এসেছে । ঘরে ফিরতে হবে ।  লাঠি নিয়ে আশির্বাদ  চলতে লাগল । সাধন  আশির্বাদকে ধরতে গেল ।  আশির্বাদ  বলল, "না । আমাকে  ধরতে হবে না । আমার মাথা ঘোরা, শরীর দুর্বলতা  সেরে গিয়েছে ।"  আশির্বাদ  একাই লাঠিতে ভর করে ঠকঠক করে চলতে লাগল ।  একা--একা  লাঠি হাতে  ঠকঠক করে  অপরের সহায়তা  ছাড়া  চলতে  চলতে  আশির্বাদ  বুঝতে পারল, লাঠি মানুষকে হাঁটতে এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করা ছাড়াও  মানুষকে  অসীম  সুখ দেয়, অপার  আনন্দও  দেয় ।   পেছনে তখনও অনেক লোকের সমবেত কান্না চলছিল  । কাঁদাকাঁদির মেলা চলছিল ।
     সাধন আশির্বাদের হাত  ধরে টোটোতে ওঠাতে গেলে  আশির্বাদ সাধনের সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করে একা--একা  টোটোতে গিয়ে উঠল । সাধন আশির্বাদের পাশে গিয়ে বসল । সন্ধে বেলায় অম্বালিকাকেও ঘরে ফিরতে হবে ।  ওপারে  অম্বালিকা  একা তাদের গাড়িতে চালকের আসনে বসা স্বামীর পাশে  গিয়ে বসল । গাড়ির কাচ তুলে লাঠি বের করে  লাঠি উঁচিয়ে অম্বালিকা  আশির্বাদের দিকে তার   লাঠিটি এদিক--ওদিক  নাড়াতে লাগল ।  মনে --মনে বলল, "  আশির্বাদ, আমার ক্যানসার হয়েছে । ডাক্তার বলেছে, আমি আর তিন মাস বাঁচব । পরের  বছর আর দেখা হবে না ।  আর কোনও দিন দেখা হবে না । বাই--বাই ।"
     সাধনের পাশে বসা আশির্বাদ  লাঠিটি উঁচু করে  অম্বালিকার উদ্দেশ্যে  লাঠিটি এপাশ--ওপাশ  নাড়াতে লাগল। মনে--মনে বলল, " অম্বালিকা, পরের বছর আবার দেখা হবে এই মাকড়হাটের মেলায়।  টা-- টা।"

গোলোকেশ্বর  সরকার
দক্ষিন দিনাজপুর 
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত