অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মেয়েটি - জাকির সোহান

বাবা মারা গেলে পড়ালেখা লাটে উঠল। পড়ালেখা ভালো লাগত না। স্কুলে নাম কুড়িয়েছিলাম ফুটবল খেলার জন্য। গ্রামের মানুষ। সংসারের হাল ধরতে মুদির দোকান দিলাম। দিনকাল কোন মতে চলতে লাগল। স্কুলের ছেলেদের সাথে ভালো যোগাযোগ থাকলেও মেয়েদের সাথে কোন যোগযোগ ছিল না। বছর দুয়েক পর জানলাম আমার সাথে পড়ত একটা মেয়ে- নাজমা-ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। 

গ্রামে মেয়ের সাথে যোগাযোগ থাকলে লোকে অন্য চোখে দেখে। এই মেয়েটার সাথে স্কুলে পড়াকালীন কখনো কোন কথাই হয় নি। গ্রামে মুখে মুখে তার নাম ঘুরতে লাগলো- সবাই তার প্রশংসা করছে। পাঁচ-ছয় মাস পর একদিন দোকানে এক মেয়ে এসে হজির। হ্যাবি স্মার্ট। গ্রামে এত স্মার্ট মেয়ে তো নেই। আর আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলো। একটু চমকে উঠলাম। দেখি- এ যে নাজমা! শহরে গেলে মানুষের ভাব বাড়ে, অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না- এ মেয়ে যে তার উল্টো। আমার খোঁজ নিতে এসেছে! পরপুরুষ  দেখলে গ্রামের মেয়েরা যেমন লজ্জা পায় তেমনি শহুরে শিক্ষিত নাজমাকে দেখে আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। অনেক কথা হল। ছেলে বন্ধুরা যত আন্তরিক হয় নি নাজমা নিমেষেই খুব আন্তরিক হয়ে আমার ফ্যামিলি থেকে শুরু করে পাড়াপড়শি সবার খোঁজ নিতে লাগলো। আমি বিস্ময়ে এবং লজ্জায় নাজমার দিকে তাকাতে থাকি মাঝে মধ্যে। মানুষ এত ভালো হয়? ভাবতাম ছেলেরাই ছেলেদের বন্ধু হয়, আপন হয় কিন্তু নাজমা সে ধারনা পাল্টে দিলো। এরপর থেকে নাজমা  যতবার-ই গ্রামে এসেছে আমার দোকানে আড্ডা দিয়েছে। তার মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক পরিকল্পনা। গ্রামকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। স্কুল করবে, হাসপাতাল করবে আরও কত কী। নাজমা কে  গ্রামের লোকজন খুব ভালোবাসতে লাগলো। বিশেষ করে শীতের সময় গরম কাপড় বিতড়ন করায় মানুষ ওর জন্য অনেক দোয়া দরুদ পড়ে। বন্যার সময় ঢাকার বন্ধুদের নিয়ে শুকনা খাবার, স্যালাইন, ওষুধ দিত। নাজমার সাথে আমিও যেতাম গ্রামের জন্য এই সব কাজে। সব বিষয়ে আন্তরিক হলেও একটা বিষয়ে কেন জানি কেমন কেমন করে। ও মনে হয় অসুস্থ। যদি ওকে এত পরিশ্রম করতে না দিই এজন্য বুঝি গোপনে ওষুধ খায়। মানুষ-ই তো ওষুধ খায়। তাই ওসবের মধ্যে মাথা গলাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সে গোল্ড মেডেলিষ্ট ছিলো। অর্নাস মার্স্টাসে প্রথম। 
   একবার গ্রামে আসলে ওকে দেখি অন্যরকম লাগছে। উদাসীন। জোড় করে ভালো আছে এটা বোঝাতে চায়। গ্রামের মানুষ অত কিছু বুঝিনা। 
 ও বলে, পড়াশুনা মনে থাকে না- তোর মত দোকানদার হবো। 
 আমি হাসি। বলি- আমার ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বালাইস না। 
    ও- হাসত। বলত- তোকে দেখে ঈর্ষা হয়। কত সুখে আছিস! চাকুরী বাকুরীর টেনশন নাই। আরামে আছিস। 

 নাজমা বড় চাকুরী করার স্বপ্ন দেখত। সেজন্য অনেক পড়াশুনা করতে হয়। পড়াশুনার প্রেশার বেড়ে গেছে। অনেক ওষুধপাতি খায়। চেহারার উজ্জলতা কমে গেছে। গ্রামের মেয়েরা নাকি কুড়িতে বুড়ি হয় আর ও শিক্ষিত মেয়ে একটু দেড়িতে হলেও অন্যরকম বুড়ি হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে টেনশন না করতে। নাজমার অবস্থা এত ভয়বহ তা জানতাম না। নাজমার ছোট বোন জানালো- আপা হঠাৎ কোন দুঃসংবাদ শুনলে র্হাট ফেল করে মারা যেতে পারে। আর সুখবর শুনে উত্তেজিত হলেও একই সমস্যা হতে পারে।  পড়াশুনা শেষ করার বেশ কয়েক বছর হল- তার চাকুরী হচ্ছে না।

 কয়েকবার ভাইভা থেকে ফেরত এসেছে। নাজমার মন আরও খারাপ হতে লাগলো। ওষুধের মাত্রা বাড়তে লাগলো। তারপর কয়েক বছর কোন খোঁজ নেই। আমারও সংসার সামলাতে হয়-ওর-ও কোন খোঁজ নেই নি। একদিন শুনলাম নাজমা মারা গেছে। বি.সি.এস-এর ভাইভার রেজাল্ট যখন দেয়- ওর পাশের খবর শোনামাত্র উত্তেজিত হয়ে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়। হাসপাতালের ডাক্তার জানায়, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়ায় ব্রেনে রক্ত ক্ষরনে সাথে সাথে মারা গেছে। এনার্জি আর স্মৃতি শক্তি বাড়াতে নিষিদ্ধ ড্রাগস সেবন করত। সেজন্য ব্রেন, শরীর লুজ হয়ে গেছে। ওষুধ কাজ করে না। দোকান বন্ধ রেখে ওর নামাজে  জানাজায় গিয়েছিলাম। আসার পথে মনে প্রশ্ন জাগলো- গোপনে কি খেত? এরপর ওসবের উত্তর না খুঁজে বেঁচে থাকার তাগিদে দোকানটা খুলি লাভের আশায়।

জাকির সোহান
টাঙ্গাইল, বাংলাদেশ