অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু - মোঃ আইনাল হক

ই অত্যাধুনিক চকচকে সময়ে প্রদীপের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার কথা শুনে হয়তো অবাক হবেন। ভাববেন; যখন নিয়নের আলোয় ভেসে যায় নাগরিক জীবন, বিদ্যুতের ঝলকানিতে চমকপ্রদ সভ্যতার চোখ, তখন প্রদীপের আগুনে মানুষ মারা যায় নাকি! তাই না? এ হয়তো নিছক গাল গল্প হতে পারে। হতে পারে কল্পনার আঁচড়ে লেখকের নিবেদন। কিন্তু না; কিছু বাস্তবতা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ক্রমবিকাশমান সভ্যতার সাথে সকল মানুষের বিবর্তন আসলে কতটুকু। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি পরিমাপ করতে গেলে সেই দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য মানুষটির অর্থ দিয়ে মাপতে হয়। তবেই প্রকৃত অর্থনীতির সঠিক হিসেব পাওয়া যায়। 

কিছু দুষ্কৃতকারী জনপ্রতিনিধিদের স্বেচ্ছাচারিতায় সরকারি সেবা প্রান্তিক জনগনের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। অধিকার বঞ্চিত হয় প্রকৃত দাবিদার। এবং সেই সাথে সমালোচিত হয় সরকার বাহাদুর। রতনপুরের জরিনা বিবি সাদা কাপড়ের সাথে সখ্যতা গড়েছে প্রায় বছর পনেরো হলো। সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে দুটি মেয়েকে পাত্রস্থ করার পর দারিদ্র্যতার সঙ্গে সম্মুখ সংগ্রামে পরাজিত হয়ে স্বামীর পরলোক গমনের সাথে শুরু হয় তার বৈধব্য জীবন। চোখের পলকে জরিনা বিবি থেকে হয়ে গেল জরিনা বেওয়া। সাদাকালো এ জীবন যেন মহাকালের অনন্ত জীবন। দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের জন্য, পরনের মোটা বস্ত্রের জন্য পরমুখাপেক্ষীতা যে কতটা যন্ত্রণার, কতটা অবহেলার; তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে জানে! শুধু কি তাই? নিজস্ব বাস্তুভিটাহীনতার দরুন রাস্তার ধারে নিজহাতে তৈরিকৃত এক জীর্ণ কুটিরে মাথা গুঁজে চলে জরিনার জীবন সংগ্রাম। এটাকে বরং জীবন সংগ্রাম না বলে ওপারের ডাকের তীব্র প্রতীক্ষাও বলা যেতে পারে। অথচ কত কিছুই না হতে পারতো; বিধবা ভাতার কার্ড হতে পারতো, বয়স্ক ভাতা পেতে পারতো, সৌরবিদ্যুতের সুবিধা পেতে পারতো, এমনকি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি পর্যন্ত হতে পারতো। কিন্তু জরিনা বেওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সব সম্ভাবনা অন্য কারো পেটে আশ্রয় নিয়েছে। অতিপরিচিত সেই পেটের কথা নাই-বা উল্লেখ করলাম গল্পে। নাগরিক অধিকার দূরের কথা, সাধারণ সুবিধা পাওয়ার জন্য যে কাঠ-খড় পুড়াতে হয় তা কল্পনাতীত। শেষ ভরসা স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা জরিনা বেওয়া এসব সুবিধা পেতে যে দৌড়ঝাঁপ করে নি তাও নয়। কিন্তু ঐ যে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সুবিধা নয়! স্বামী গত হবার পর  বিধবা ভাতার কার্ডের তদবিরে বেশ কয়েকবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মেম্বার সাহেবের কাছে যায় জরিনা বেওয়া। জরিনা জানে না বিধবা ভাতার জন্য স্বামীর মৃত্যুর পরেও আর কি প্রমাণ দিতে হয়। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দারিদ্র্যতাকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে খাদ্যের সন্ধানে যেতে হয় এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। হজম করতে হয় শত ধিক্কার। মানব জীবন এতো তুচ্ছ হয়! হীন এ জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানো বড়ই যন্ত্রণার। বিধবা ভাতার কার্ডের আশায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ জরিনা বেওয়া সোজাসুজি মেম্বরের বাড়িতে যায়। 

- ক্যা বাপো বাড়িত আচেন? কো, কাকো জি দ্যাকোচিনা। হায়রে আল্লাহ! একনো উটেন নি?  আজক্যা আর দেকা না কইরা যাত্তি না। যেত দেরি হয় হোক।

- কে? কে চিল্লাপাল্লা করচেন? ওটি ব্যারে বসেন। আব্বা ঘুমাত্তে, ডাকতে নিষেদ করিচে। উটলে দেকা করবেন।

অগত্যা পাশে রাখা একটি টুলে বসে পড়ে নিয়তির কাছে হেরে যাওয়া অতি দুঃখী, অসহায় ও অনুকম্পায় যাপিত জীবনের রাজ স্বাক্ষী এই মহিলা। গতকয়েক বার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ায় এবার কঠোর সংকল্প চোখে মুখে। যত দেরি হোক আজ দেখা করতেই হবে।

জনগণের সেবার জন্য নির্বাচিত করা হয় জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি হবে জনগণের সেবক। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবে, প্রয়োজনে সৎ পরামর্শ দিবে, রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিবে জনগণের দাড় গোড়ায়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুবিধা ভোগ করে রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। সুখী জীবন যাপন করবে এটাই তো নিয়ম। কিন্তু যদি স্বাভাবিক সিস্টেমের ব্যত্যয় ঘটে? যদি জনগণ জিম্মি হয়? যদি অপব্যবহার হয় বস্তু ও ক্ষমতার? তখন সেই সমাজ ও রাষ্ট্র সঠিক ট্র্যাক হারিয়ে ফেলে। ফলে রাষ্ট্র ও জনগনের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় অনাস্থার। 

সকাল দশটা নাগাদ তমিজ মেম্বার ঘুম থেকে ওঠলে প্রাতঃকাজ শেষে জরিনার সাথে দেখা করতে বাইরের বারান্দায় আসে।

- কি হচে বুলো দিনি। এত সকাল সকাল ডাইকা ঘরবাড়ি মাতাত তুলচেন ক্যান? মানুষক এনা ঘুমাবারও দিবেন না?

- বাবা! হামি বড় বিপদে পইড়া আলচি বাবা। তোমার চাচা মইরা যাবার পর থাইকা খাইয়া না খাইয়া দিন পার করোচি। গতবার ভোটের কাড না কি সেগলাও দিয়া গেচি, তে হামার ব্যবস্তা হয় নি? এনা ভাতা পামু না?

- চাচি, তোমাক তো বুলিচি কাজ চলোচে। ছয় মাসেও হতে পারে আবার এক বচরও লাগবার পারে। এনা ধৈর্য্য ধরো দিনি। তোমার কাডের ট্যাকা হামি মাইরা খামু?

- না সেডা বুলিনি। এদিকে তো মাস ছয়েক গ্যালো।কিন্তু খামু কি বাজান? ঘরে এক ছটাক চাউল নাই।

- তার হামি কি জানি! যাও, দিন পনোরো পরে অ্যাসো।

মানুষোক লিয়া হামার হচে যত জ্বালা। এক এই দ্যাও, তাক সেই দ্যাও। আরে বাপু! সরকার কি বাবাক মেইলা দিয়া থুচে?

- তা তো ঠিকই বুলিচেন বাজান। সরকার মেইলা দিয়া থুচে ঠিকি, কিন্তু হামারে জন্যে লয়। হামরা তো বলির পাঁটা। ভোটের দিনে ঠিকি ডাকপেন নি। একন আর সেগলা মনে নাই। তোমার দুডা পাও ধরচি বাপো, হামার কাডডা এনা কইরা দিও।

অগত্যা কষ্ট আর হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো জরিনা বেওয়াকে। চারটা ভাতের জন্যে এর ওর হাতের  কাজে সাহায্যে করে চলে জীবন। এ জীবন কেমন জীবন? যে জীবনে আনন্দ নেই, উৎসব নেই, উদ্দীপনা নেই; তা কি মানব জীবন? কখনও কখনও দিনের পর দিন চলে যায় জরিনা বেওয়ার চুলা জ্বলে না। অর্ধাহার, অনাহারে দিন পার করা যেন নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন। জরিনার মতো শতশত মানুষের প্রতিদিনের দীর্ঘশ্বাসে যে কৃষ্ণ গহ্বরের তৈরি হচ্ছে তাতে হয়তো হারিয়ে যাবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। হয়তো মুছে যাবে মানবিকতার বিশাল ক্যালিওগ্রাফি।

বছর অতিবাহিত হয়েছে, নতুন বছর এসেছে এবং চলেও গেছে। শুধু আসে নি জরিনা বেওয়ার বিধবা ভাতার কার্ড। দূর্বিষহ জীবন কাঁধে নিয়ে চলতে চলতে বয়সের ভারে ন্যূজ্ব হয়েছে দেহ। এখন আর চোখে স্বপ্ন নেই, বাঁচার আকুতি নেই, মনে প্রাণ নেয়। অমানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সঁপে দিয়েছেন সব। শেষমেশ মেম্বার সাহেব বিধবা ভাতার কার্ড নয় বরং বাড়িতে সৌর বিদ্যুতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্ত করেছেন জরিনাকে। যে জীবন বাঁচতে চায়, তাতে খাদ্য না দিয়ে বিলাসিতা দেবার যে দর্শন মেম্বার সাহেব দেখিয়েছেন তাকে অভিনন্দন নাকি ভৎসনা জানানো দরকার তা সময়ই বলে দেবে।

একদিন ঠিক মাগরিব পরপর জরিনা বেওয়ার জীর্ণ কুটির থেকে বুক বিদীর্ণ চিৎকার, "বাঁচারে হামাক কেউ বাঁচা, আগুনে মইরা গেনু। কালকা হামার সৌরবিদ্যুৎ আসপে।" 

হাঁকডাক শুনে লোকজন দৌড়ে এসে দেখে জরিনা বেওয়ার সারা শরীরে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। ভেজা বস্তা পেঁচিয়ে ও পানি ব্যবহারের মাধ্যমে যখন আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে, ততক্ষণ শরীরের বেশি অংশ পুড়ে গেছে। জানা যায়, রাতে খাবার শেষে উঠতে গেলে মেঝেতে রাখা প্রদীপের আগুন শাড়ির আঁচলে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিভাগীয় হাসপাতালের কথা বলেন। পৃথিবীর সমস্ত অভিমান মুছে ফেলে হাসপাতালের রাস্তায় নিগৃহীত জীবনের যবনিকা টেনে সৃষ্টিকর্তার কৃপাপেক্ষী হয় ইহ জগতের বেদনার্ত জরিনা বেওয়া। আমাদের জন্য রেখে যায় বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতার কার্ড; রেখে যায় সৌরবিদ্যুতের ঝলমলে আলো।

মোঃ আইনাল হক
মান্দা নওগাঁ