অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
বইমেলা নিয়ে কিছু কথা -অপূর্ব শর্মা

“বইমেলা কেবল বই কেনা-বেচার জন্য নয়; বইমেলা বাঙালির ‘প্রাণের মেলা’।” মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বইমেলা নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অভিব্যক্তি আমাদের জীবন প্রবাহে বইমেলার গুরুত্ব ঠিক কতোটা তারই যেনও প্রতিধ্বনি। শুধু এই কথাটি বলেই থেমে থাকেন নি তিনি, রাষ্ট্রনেতা হওয়ার কারনে নানা বিধি নিষেধের বেড়াজালে থাকায় ইচ্ছে হলেই মেলায় না আসতে না পারার বেদনার কথাও তিনি স্বীকার করেন অকপটে। তাঁর ভাষায়, ‘আগে যখন ক্ষমতায় ছিলাম না, তখন এই মেলায় অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। আর এখন অনেকটা বন্দি জীবন, এখন ইচ্ছা থাকলেও আসা যায় না। আর আসলেও অন্যের অসুবিধা হয়। সত্যি কথাটা কি, মনটা পড়ে থাকে বইমেলায়।’ ‘মনটা পড়ে থাকে বইমেলায়’ কথাটি একটু জোর দিয়েই বললেন প্রধানমন্ত্রী। হ্যাঁ, সময়ের বিবর্তনে সত্যি সত্যি আজ বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। সেই মিলনমেলায় অংশ নিতে দেশ বিদেশের বাঙালীদের ঢল নামে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। প্রতিবারের মতো এবারও এর অন্যথা হয়নি। প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে যখন ধাবমান বইমেলা তখন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, গবেষক এবং পাঠকদের পদভারে মুখরিত মেলাঙ্গন। বিগত বছরগুলোতে বইমেলার প্রচার প্রসারে পত্র-পত্রিকার যে ভূমিকা ছিলো সেটা বলবৎ থাকলেও এবার অনেকটা জোরেশোরেই ফেসবুকে চলছে প্রকাশিত বইয়ের প্রচার-প্রচারণা। আকর্ষণীয় এবং নান্দনিক করে ফেসবুকে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন লেখক, প্রকাশকরা। এই প্রচারণায় প্রকাশকদের চাইতে এগিয়ে আছেন লেখকরা। পাঠকদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করছেন তারা। যার ফলে প্রকাশিত বই সম্পর্কে সহজেই ধারণা পেয়ে যাচ্ছে অনেকে। যা সহায়ক হচ্ছে গ্রন্থ ক্রয়ে। 

ফেসবুক আছে অথচ প্রকাশিত বইয়ের প্রচারণা চালাচ্ছেন না এমন লেখক নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠিত লেখক থেকে শুরু করে নতুন লেখক প্রত্যেকেই কথার যাদুতে আবিষ্ট করতে চাচ্ছেন পাঠকদের। স্বদেশে কিংবা প্রবাসে যেখানেই আছেন লেখক সেখান থেকেই নিজ বইয়ের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন কথার পিঠে কথা বসিয়ে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে লেখালেখি চালিয়ে আসা কবি শামীম আজাদও পিছিয়ে নেই প্রচারণায়। নিজ বইয়ের বিজ্ঞাপন তিনি ফেসবুকে দিয়েছেন বেশ নান্দনিকতায়। ‘ইহা একটি বই-বিজ্ঞাপন’ শিরোনামে প্রকাশিত বই নিয়ে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাস, ‘এবারের বইমেলায় শামীম আজাদের যে তিন খানা বই বেরুচ্ছে তার সবক'টাই অনন্য। ইংরাজী বাংলা মিলিয়ে এ যাবত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা পঁয়ত্রিশোর্ধ হলেও এবারের তিন খানা বই তা থেকে মেজাজ ও মননে একেবারেই অন্যরকম।’ প্রকাশিত কইন্যা কিচ্ছা নিয়ে তার বক্তব্য, গ্রন্থটি ‘নারী পরম্পরা নিয়ে সিলেটি বয়ানে লেখা এবং এ বইটি মূলত বাচিক শিল্পীদের জন্যই লেখা। এর মন্ত্রনাদাতা দুই প্রতিথযশা বাচিক শিল্পী রূপা চক্রবর্তী ও মুনিরা পারভিন- যাঁরা বাংলাদেশ ও বিলেতে পরম মমতায় আমার শোলকগুলো তুলে নিয়েছেন তাদের মায়াধারি কন্ঠে। মাত্র এক ফর্মার হালকা পাতলা এ বইটি হাতে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়ালে দূর থেকেও দৃষ্টিগোচর হবে এর প্রচ্ছদের কইন্যাদের শ্রী।

এটি প্রকাশিত হচ্ছে আরো একজন সিলেটি কন্যা এবং জাগৃতি প্রকাশন এর স্বত্তাধিকারী রাজিয়া রহমানের মুগ্ধ আগ্রহে। পাবেন জাগৃতির ২২২ ২২৩ ও ২২৪ নং স্টলে। মূল্য মাত্র ৮০ টাকা।’ এই স্ট্যাটাসে একইভাবে আরও দুটি বইয়ের কথা বলেছেন লেখিকা। শামীম আজাদের মতো আবু হাসান শাহরিয়ার,  মোহিত কামাল, মঈনুল আহসান সাবের, আনিসুল হক, প্রমুখ লেখকরাও নিজ নিজ বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছেন ফেসবুকে। প্রচারমাধ্যমগুলোও বইমেলার খবর প্রকাশে সরগরম। বইপ্রকাশের সাথে সাথেই বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা। দিন শেষে প্রকাশ করা হচ্ছে তালিকা এবং ক্যাটাগরী অনুযায়ী জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে বইয়ের সংখ্যা। যার ফলে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য সহজ হচ্ছে বই কেনা।

বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যান অনুযায়ি প্রথম সপ্তাহে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সাত শতাধিক বই। একাডেমির ফেসবুক পেইজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ি মেলার দ্বিতীয় দিন শনিবার প্রকাশিত হয় ৮১টি বই, তৃতীয় দিন রবিবার প্রকাশিত হয় ১৩৮টি, চতুর্থ দিন সোমবার এসেছে ১৪১টি বই, পঞ্চম দিন মঙ্গলবার ১৫২টি, ষষ্ঠ দিন বুধবার প্রকাশিত হয়েছে ১৫২টি নতুন বই। প্রকাশিত গ্রন্থের অধিকাংশই কবিতার বই। প্রবন্ধ নিবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। তবে, ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে উপন্যাস এবং সায়েন্স ফিকশন। আর এক্ষেত্রে লেখক হিসেবে যথারীতি শীর্ষে রয়েছেন জাফর ইকবাল। পাশাপাশি হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, হরিশংকর জলদাশ, মোহিত কামাল, আনিসুল হকের বইয়ের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহের মাত্রা বেশি।   

প্রথম সাপ্তাহে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। ইত্যাদি প্রকাশ করেছে হাসান আজিজুল হকের ‘স্মৃতি কথন’ এবং ‘কিশোর সমগ্র’ একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের ‘বিষণ্ণ শহরে দহন’ এবং ‘ঘরগেরস্থির রাজনীতি, প্রথমা এনেছে আনিসুল হকের ‘এই পথে আলো জ্বেলে’, বিদ্যা প্রকাশ এনেছে মোহিত কামালের ‘লুইপা’র কালসাপ, চৈতন্য বের করেছে মুজিব ইরমের ‘পাঠ বই,   আগামী এনেছে ড. শ্যামল কান্তি দত্তের ব্যাকরণ ও অভিধান ‘সিলেটের উপভাষা।’ এবং নূরহাসনা লতিফের ‘পাকিস্তানে আটক দিনগুলি।’ জার্নিম্যান বুক প্রকাশ করেছে কবি মুহাম্মদ সামাদের ‘আমি তোমাদের কবি’, এবং ‘সোশাল সার্ভিস একটিভিটিস অব রিলিজিয়াস ইনস্টিটিউশনস ইন বাংলাদেশ।’

সময় প্রকাশন এনেছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘নির্বাচন ও প্রশাসন, আগামী প্রকাশনী এনেছে মোহাম্মদ নাসিমের ‘সংসদের তিন প্রজন্ম, অন্যপ্রকাশ থেকে মেলায় এসেছে মারুফুল ইসলামের কবিতার বই ‘বিশ্বাসীও নই ভ-ও নই। একই প্রকাশনা বের করেছে মাহমুদ আখতার শরীফের উপন্যাস ‘নাটকের চতুর্থ পর্ব।’ এবং মানুষ প্রকাশ করেছে কবি কবিতার বই ‘নিরুপায় বৃত্ত, কথাপ্রকাশ বের করেছে মুস্তাফিজ শফির ‘ব্যক্তিগত রোদ এবং অন্যান্য’ একই প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে শাকুর মজিদের ‘বুয়েট কাল’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. এনেছে নাসরীন জাহানের কবিতার বই ‘এসেছি সূর্যাস্ত থেকে, কথা প্রকাশ এনেছে পলাম মাহবুবের ‘কম বয়সি সন্ধ্যা, দি রয়েল পাবলিশার্স এনেছে আহমদ মতিউর রহমানের ‘ভাষা আন্দোলনে পাঁচজন শহিদের জীবন কথা।

প্রতিদিনই নতুন নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। পুরো মাস জুরেই সেটা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু সেই অনুপাতে কি বই বিক্রি হচ্ছে? এর উত্তর পাওয়া যাবে কবি ফরিদ কবিরের স্ট্যাটাসে। মেলা শুরুর পরের দিন ফেসবুকে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ এক আজব দেশ। এদেশে একটা বইয়ের তিনশো কপি ছাপা হয়। কিন্তু লেখক অন্তত পাঁচ হাজার (ধরে নিচ্ছি, আড়াই হাজার লেখকের গড়ে দুটো করে বই বের হবে। আর বাকি আড়াই হাজারের কোনো বই এবার বেরোবে না) শুধুমাত্র লেখকরা একটা করে বই কিনলেই একটা বইয়ের ৫০০০ কপি বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না।

আশির দশকে আমরা যখন লিখতে শুরু করি, তখন দেশের জনসংখ্যা ছিলো এখনকার অর্ধেক। অথচ, সে সময় আমাদের মতো নবীন কবিদেরও একটা কবিতার বই ছাপা হতো ১২৫০ কপি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের ২২৫০ কপি। আমার দ্বিতীয় বই, ‘ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল' ছাপা হয়েছিলো ২২৫০ কপি। এখন আমার কবিতার বইও ছাপা হয় ৩০০ কপিই। এখন কোনো কবিই ২২৫০ তো দূরের কথা, ১২৫০ কপি কবিতার বই ছাপার কথাও কল্পনা করতে পারবেন না! তবে কি কমে গেছে প্রকৃত কবিতার পাঠক?

আমি বলবো, কমেছে। পাঠের অভ্যেস আমাদের এখন প্রায় নেইই।’ ফরিদ কবিরের এই স্ট্যাটাস সত্যিই বেদনার। জনসংখ্যা এবং লেখক বাড়লেও বাড়ছে না পাঠকের সংখ্যা! আর পাঠকই যদি না বাড়ে তাহলে এত্ত এত্ত বই লিখে কি হবে? তাই পাঠক বৃদ্ধির দিকেই নজর দিতে হবে এখন। নইলে একদিন প্রাণ হারাবে প্রাণের মেলা, তখন আফসোস করেও কোনও লাভ হবে না।

অপূর্ব শর্মা
সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, 
সিলেট, বাংলাদেশ।