অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
অভিবাসী মন… (শেষ পর্ব) – ফরিদ তালুকদার

অভিবাসী মন… ( প্রথম পর্ব) পড়তে কিল্ক করুন

যাহোক বলছিলাম জীবন সুরঙ্গের কথা। প্রাক তারুণ্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম পড়ে আমার মধ্যে বিশেষ দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। প্রথমটি হলো একরকম মানসিক বিভ্রাট এবং দ্বিতীয়টি হলো স্বচক্ষে তুষার পাত দেখার প্রবল ইচ্ছা। প্রথমটির কথা কখনো হয়তো অন্য কোথাও বলা যাবে। তবে তুষার পাত দেখার সাধ যে মাত্রার চেয়েও অনেক বেশী পূর্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত তুষার স্তূপের নীচে চাপা পরে ফসিল হয়ে যাবে তা কখনো জীবনের দূরতম কল্পনার মাঝেও ছিল না। বন্ধু বান্ধবদের অনেকে ইন্টার পাশ করার পরপরই বিদেশে হিজরত করার চেষ্টায় রাত দিন যেন এক করে ফেললো। আমাকে প্রায়শঃই তাদের দলভুক্ত করতে চাইলে আমার একটাই পরিষ্কার উত্তর দেশ ছাড়ব কেন? আসলে বৈশা মেলা (  আমাদের বড় মেয়ে তিতির তার শিশু বয়সে বৈশাখী মেলাকে এভাবে উচ্চারণ করত ) হবে আর আমি থাকব না, একুশের বই মেলা চত্বরে আমার পায়ের ছাপ পড়বে না, পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়ি বা আর্ট কলেজের পিছনে ঐ ছোট গভীর অথচ পানিহীন বুনোলতা ঘাসে ছাওয়া তলদেশের পুকুরটার পাশে সপ্তাহে অন্তত একবার গিয়ে বসব না, পহেলা ফাল্গুনের মাতাল বাতাসে বঙ্গ ললনাদের বাহারী আঁচলের পাখা মেলে ওড়াউড়ির মনোহরিণী দৃশ্যের সুখ বঞ্চিত হৃদয়… এটা কি করে সম্ভব তা ছিল আমার বোধের অগম্য! কিন্তু আমার বোধে যা ই থাকুক.. সময় এবং ঐ যে সুরঙ্গের কথা বললাম তারা কতটুকুই বা তার তোয়াক্কা করে। তা সে সুরঙ্গের রূপ আমার কর্মের ফলেই হোক আর পূর্ব নির্ধারিত ই হোক। 
ভার্সিটি পর্ব শেষ করার পরে অনেক চড়াই উৎরাই, গিরিখাদ, জীবন পথের প্রথম, দ্বিতীয়,  তৃতীয় যুদ্ধ শেষে কর্ম জীবনের গতিপথ যখন একুটুখানি সরল রেখায়, তখনই অন্য কিছু সমস্যার খানাখন্দ এসে সে পথের দখল নেয়া শুরু করলো। কাকে দুষবো? ভবিতব্য? তাহলে আমি কে? উত্তর…?  এটাই জীবন…!! মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন। মাঝে মাঝে ভাবি ছাত্র জীবনে আর একটু কম বাউন্ডুলে হলে কি হতো? কিন্তু যা হয়নি সে প্যাচাল পেরে তো লাভ নেই।  অথবা এমনটা হয়তো হবারই ছিলনা? বলাবাহুল্য জীবন যুদ্ধের এই সব গোলা বারুদ যোগাতে গিয়ে দেশে থাকতেই একসময় এই বৈশা মেলা, একুশ মেলা, রাত বারটা এক মিনিটের শহীদ মিনার…, আবেগ আবেদনের এমন পাতা গুলোতে একটু একটু করে ধুলো জমতে থাকে। “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”… সুকান্ত তোমায় হাজার ছালাম!  
অবশেষে একদিন মনের মধ্যে অনুভব করতে থাকলাম সেই দূরের বাঁশীর সকরুণ সুর…। গায়ের গন্ধ শুঁকলে এখনো যে মাটির  ছোঁয়া টের পাই, একদিন যে মায়ের বুক ছিল অবুঝ শিশুর একমাত্র নির্ভরতার প্রতীক, দূরে কোথাও খেলতে গিয়ে ফিরতে দেরি হলে দায়িত্বশীল যে বাবা সন্ধ্যার আঁধারে খুঁজতে বের হতো,  সেই সবাইকে, পিছনে ফেলে সময়ের ক্ষিপ্ত ডানায় জীবন…, জলে, স্হলে অন্তরীক্ষে সাঁতার কেটে কেটে অবশেষে এই মেরুর মাটিতে এসে প্রাণ পণ করলো তার নূতন ঠিকানা খুঁজে পেতে। শূন্য থেকে আবারও…।   আমাদের হৃদয় শূন্য হয় অহরহ। জীবন শূন্য হয় কখনো কখনো…!!
নিরস বক্তৃতা লম্বা করলে একসময় শ্রোতা তো থাকবেই না হয়তো চেয়ার বেঞ্চ গুলোও ঝিমোনি ধরে কাত হয় পড়ে যেতে পারে। এখন সেই ভয়ই পেয়ে বসেছে আমাকে। টরোন্টোর উত্তর-পূর্ব উপকন্ঠে ছোট একটি শহর আক্সব্রীজ (Uxbridge). কোন এক শীতে প্রায় মধ্যে রাতে একটা জরুরী কল পেলাম আক্সব্রীজ থেকে। শহরে ঢোকার মুখে লেখাটা চোখ কেড়ে নিলো, হয়তো মনটাও একটুখানি। “Uxbridge Welcome You” একই অর্থ, বলা যায় একই শব্দের সমন্বয়, শুধু একটু অন্যভাবে সাজানো শব্দগুলো। মনে হলো তাতেই স্বাগতম এর আন্তরিকতার মাত্রা অনেকটাই  বেড়ে গেছে। ভাল লাগলো। কলটা শেষ করে যখন ফিরি ঘড়ির কাঁটা তখন অন্যদিনে পড়ে গেছে। দুদিন আগে বৃহত্তর টরোন্টোর সব অংশেই দীর্ঘ সময় ধরে তুষার পাত হয়েছে। টরোন্টো থেকে আক্সব্রীজের রাস্তা বেশ খানিকটা ই উঁচুনিচু ঢালু পথ। রাস্তার দুপাশে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কৃষকদের বাংলো ধরনের ঘর। আর বেশীর ভাগটাই তুষারাবৃত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। সাদা চাদরের নীচে ধ্যান মগ্ন ঋষির মত। হয়ত একটুখানি নিঃশ্বাসের শব্দও ভেঙে দিবে তার মর্ত ছেড়ে অপার্থিবের পথে যাত্রার আয়োজন। নিয়মিত বিরতিতে চোখে পড়ে বার্চের ঘন বনের সারি।  সুনসান এইটুকু পৃথবীর উল্টো রাস্তায় কদাচিৎ দু’একটা গাড়ির হেড লাইট উল্কার মত দেখা দিয়ে নিমেষে হারিয়ে যায়। এপাশে সামনে পিছনে যতদূর দেখা যায় শুধু ধাবমান আমার গাড়িটাই। উপরে চাঁদ হয়তো ত্রয়োদশীর। তার কোমল আলোর নিঃশব্দ ঝর্ণার মূর্ছনায় ভেসে যায় ঘুমন্ত প্রান্তর। নীলাভ আভার হেয়ালিতে সৌম্য নিঃসর্গের এই সুর হৃদয়ে কেমন অচেনা এক পবিত্রতা ঢেলে দিয়ে যেন জাগিয়ে তুলে আর এক নবজন্মে। তুষার ঝরা দেখার শখ ছিল। কিন্তু সেই তুষারের পতনে প্রকৃতি যে এমন ঐশ্বর্য্যময়ী হয়ে ওঠে তা আজ এই মূহুর্তে না দেখলে হয়তো আমার জানা অজানা সব কল্পনা সব স্বপ্ন পরিধির বাইরেই থেকে যেতো সারাজীবন। ধন্যবাদ তোমায় আক্সব্রীজ।  অপরূপা তুমি ধরিত্রী তোমার প্রতি কোনায়…প্রতিটা বিন্দু কনায়! আমাকে শুধু উপভোগ এবং উপলব্ধি  করার ক্ষমতা দাও!!
তথ্য প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতির কল্যানে পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তের মানুষেরই এখন পাশাপাশি অবস্থান বলে আপাতঃ ভাবে মনে হয়। আপাতঃ বলছি কারন আমরা আসলেই কি এখন একে অপরের খুব কাছাকাছি? এ প্রশ্ন প্রায়শঃই মনে জাগে যখন দেখি সামাজিক মাধ্যম নামে মাধ্যম গুলো অন্তঃশীলা স্রোতের মত আমাদের আন্ত সম্পর্কে ক্রমশ একটা ফাটলের সৃষ্টি করছে। আগেই বলেছি বিবর্তন একটা অবশ্যম্ভাবি ধারা। আর এটা হয়তো সেই বিবর্তনেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। অতি পূরণ আমাদের ছোট ছোট গোষ্ঠিতে জোট বদ্ধ হয়ে বসবাসের প্রবণতার ইতিহাস । বস্তুতঃ আদিম সময়ে অন্য প্রাণীদের উপরে আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা থেকেই মানুষ এই অভ্যাসটি আস্তত্ব করেছে এবং এটা এখনো প্রচলিত আছে। বলা যায় আরও বেশী মাত্রায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেটো জোট,  প্রায় সম্পূর্ণ অকেজো ও আই সি জোট, সার্ক এবং অন্যান্য যেমন এর স্বাক্ষর বহন করে তেমনি আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, গলাচিপা কিংবা ভুরুঙ্গামারীর মত সমিতি গুলোও আদিম সেই পতাকারই নিদর্শন বহন করে। তবে বাস্তবতা হলো, জোট আমরা যতই করি না কেন,- সময়, প্রয়োজন এবং বিবর্তনের এই ধারায় প্রকৃত অর্থেই  আমরা সবাই এখন এক একটি নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি!
শুধু নির্জন দ্বীপবাস ই হয়তো শেষ নয়, কখনো মনে হয় অনু থেকে পরমাণুর মত আপন সত্তাটাই দুই ভাগ হয়ে যে যার স্হানে পড়ে থাকে একা একা। কালের ওপারে কোথাও হারিয়ে গেছে মানসিক জগত আর জাগতিক জগতের ঐক্যতান। পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব ই কেবল নয়, বলেশ্বরের তীরের সেই সোনালী শষ্যক্ষেত, মহুয়া, বটের পাতায় ফাল্গুনী উদাসী বাতাসের কানা কানি কথা এখনো অর্ধেক বেঁচে থাকা আবেগী মনকে যে ভাবে উস্কে দেয়, মেরু পৃথিবীর অদ্ভুত সুন্দর মনকাড়া এ ভূ প্রকৃতি তেমন তো উতলা করেনা। হয়তো সেকারনেই দেড় যুগের অভিবাসী এই জীবনে ঘুমের পৃথিবীতে স্বপ্ন-দুস্বপ্ন গুলো সবই প্রায় এখনও জন্মভূমির মাটিতে গিয়েই চিত্রায়িত হয়। নাড়ীর বাঁধন ই হোক বা আবেগের মহাকর্ষ টানের কারনেই হোক, বারবার যখন ফিরে আসি ফেলে আসা দুয়ারে, মানসিকতার অন্য রূপ কেমন যেন ব্যর্থ আর ব্যাথিত হয় প্রবহমান সেই জীবনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে। ভিন্ন মাটির  ছাঁচে সে যে এখন অনেকটাই পরিবর্তিত। একদিনের উপরে ফেলা শেকড়ের বিস্তার যে এখন এই মাটিতেই। অনিবার্য এই পরিবর্তনে অনেকটাই নূতন অবয়বে এখন, একমুখী সুরঙ্গ পথের এই জীবন।
পিছনে অতীত ঢেকে যেতে থাকে কুয়াশার আবছায়া চাদরে। সামনে আঁধারে, অজানা দূরত্বে কোথাও নিশ্চিত জানি বহির্গমণ লাইন। যত করি ছোঁড়াছুড়ি হাত পা মস্তিষ্কের ব্যবহার, সুরঙ্গের ছাঁদ ফুঁড়ে জীবন… কখনও ছুঁবে না ইচ্ছের আকাশ। 
স্বাধীন কখনো তবু অভিলাষী মন। ইচ্ছে করলে সকাল-সন্ধ্যার বিভোর কোন অবকাশে সে হারিয়ে যেতে পারে রজনী কান্তের “তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে…” বা জোয়াকুইন রড্রিগেজের “কনসার্টো ডি আরানহুঁয়েজ” এর সুরে সুরে। হৃদয় আকাশে ছড়িয়ে দিতে পারে জারুল কৃঞ্চচূঁড়ার মাখামাখি রংয়ে অলস গোধূলির সুখ, গ্রীষ্মের যে কোন বিকেলে।  অথবা হিম কোন নিশীথে কান পেতে শুনে নিতে পারে বার্চের শেখরে জমা মৌনতার পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত একাকী নেকড়ের আর্তচিৎকার…. এইতো বেঁচে থাকা। আবেগী মনের কোনে এইতো জীবন। সুরঙ্গ পথের জীবন…। নূতন সোনার গাঁয় …!!

ফরিদ তালুকদার
টরন্টো, কানাডা।