অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
দুই গাছের গল্প – ফরিদ তালুকদার

দুই গাছের গল্প, বিচিত্র এই প্রকৃতির টুকরো দুটি চিত্রের, দুটি গাছের বর্ণনা। পৃথিবীর দুই গোলার্ধে অবস্থিত সবার কাছেই বেশ পরিচিত এ দুটি গাছের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য–বৈসাদৃশ্য কে তুলে ধরাই মূলতঃ ছোট এই আলোচনার লক্ষ্য।  
খেজুর গাছকে ( তাল গাছকেও এ আলোচনায় আনা যায় ) চিনেনা কিংবা খেজুরের উপাদেয় গুর এবং তা দিয়ে তৈরী খাদ্য সামগ্রীর সাথে পরিচিত নয় বঙ্গ ভূমিতে এমন শিশুটিও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে এর সাথে আলোচনায় আসা ম্যাপল গাছ বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে সুগার ম্যাপল গাছের সাথে হয়ত অনেকেরই পরিচয় নেই। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে বিশেষ করে কানাডা আমেরিকায়ই এ গাছটি বেশী দেখা যায়। আকৃতি বা অবয়বে খেজুর গাছের সাথে এর খুব একটা মিল না থাকলেও কার্যকারিতার দিক থেকে রয়েছে যথেষ্ট সাদৃশ্য।  
খেজুরের রস এবং তা থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন রকম খাদ্য দ্রব্য যেমন বাঙালী খাদ্য সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ তেমনি ম্যাপল রস থেকে উৎপাদিত ম্যাপল সিরাপ ও অন্যান্য খাবার উত্তর আমেরিকার মানুষের খাদ্য সংস্কৃতির ও একটি বিশেষ অংশ। খেজুর রসের ব্যবহারে আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন রয়েছে পৌষ পিঠা উৎসব এখানেও তেমনি হয় বিভিন্ন রকম ম্যাপল সিরাপ উৎসব।  
দুটো গাছ থেকে রস সংগ্রহের মাঝেও রয়েছে  কিছুটা মিল-অমিল। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের শেষ  দিকে খেজুর গাছের মাথার ( কাঁদির  )  কাছাকাছি জায়গাটায় পূরণ কিছু শাখা এবং বাকল ফেলে পরিস্কার করে সেখানে রসের প্রবাহ  এবং তা সংগ্রহ করতে কলসি ঝুলানোর ব্যবস্থা করা হয়।  সেক্ষেত্রে ম্যাপলের রস সংগ্রহের পদ্ধতি একই হলেও এর আয়োজন খুবই কম ঝামেলা মুক্ত। এখানে রসের প্রবাহ এবং তা সংগ্রহের ব্যবস্থা থাকে গাছের গোড়ায়। তবে এক্ষেত্রে ও গাছের পূরণ বাকল কিছুটা পরিস্কার করে নিতে হয়। পৌষ এবং মাঘ, মূলতঃ এ দু'মাস ই খেজুর রস সংগ্রহের সময়। আর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত হলো ম্যাপলের রস সংগ্রহের সময়। সময়ের এই হিসেবটা স্হান এবং আবহাওয়ার উপর ও নির্ভর করে। কারন তাপমাত্রা জিরো ডিগ্রীর উপরে থাকতে হয়।
মাটিতে জমে থাকা পানি এবং মিনারেল শেকড়ের মাধ্যমে শুষে নিয়ে বৃক্ষ তা সঞ্চালন করে দেহে। তাপমাত্রা যখন জিরো ডিগ্রীর উপরে থাকে তখন সালোকসংশ্লেষণ ( photosynthesis ) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছের দেহে যে শর্করা তৈরী হয় তা থেকে হয় চিনি। মাটি থেকে শোষণ কৃত পানির সাথে এই চিনির মিশ্রণের ফলে তৈরী হয় ম্যাপল রস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গাছের শরীরে বাড়তি চাপের ( pressure ) সৃষ্টি হয়। ফলে এর দেহের প্রধান কান্ডের বাহিরের দিকের স্তরে শুরু হয় এই রসের ধারা। গাছের দেহে ট্যাপ করে এই প্রবাহকেই আমরা বাইরে নিয়ে আসি। ম্যাপল রসে চিনির পরিমান থাকে ২% এর মত। প্রায় ৪০ গ্যালন ম্যাপল রস থেকে ১ গ্যালনের মত ম্যাপল সিরাপ পাওয়া যায়। তবে এই হিসেবে মাটি এবং গাছের প্রকৃতির কিছুটা ভূমিকা থাকে। খেজুরের রসে পানি এবং চিনির অনুপাতের সঠিক হিসেবটা আমার জানা নেই। তবে ছোট বেলায় পান করার অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করছি এই রসে চিনির শতকরা হারটা হয়তো একটু বেশী ই হবে এবং এক্ষেত্রে ও মাটি এবং গাছের প্রকৃতির একটা ভূমিকা থাকতে পারে।
সন্ধ্যার কাছাকাছি কোন এক পৌষের দিন। ধানের ক্ষেতের পারে ১০/১২ বছরের খেজুর গাছের কাঁদিতে ঝোলান কলসী। ডেরা ছেড়ে তখনও বেড় হয়নি কোন বাদুড়। কিন্তু আমি…? ধানের শীষকে ছোট পাইপ ( straw ) বানিয়ে গাছের ডগায় ঐ কলসিতে জমা ফ্রেশ রসে চুমুক দিয়ে পানের মজা, আনন্দ, শিহরণ এখনও জেগে আছে মনোময়…! গত ৬ই এপ্রিল, টরোন্টোর উপকন্ঠে ছোট শহর এলমিইরার ( Elmira ) ম্যাপল সিরাপ উৎসবে গিয়ে একটুখানি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম নস্টালজিক মনের পাতায়। জীবন যখন যেখানে যেমন..! 
নিত্য জীবনের পরিমণ্ডলে, প্রকৃতির অঙ্গন জুড়ে হর হামেশাই আমরা কত বিচিত্র বিষয়ের সংস্পর্শে আসি, অবলীলায় ব্যবহার করি কিন্তু বেশীর ভাগ সময়ই ভাবিনা কতটা রহস্য কতটা বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে এর আড়ালে। অথবা জেনেও কখনো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই প্রকৃতির অসীম এই উদারতা..! আমরা তো এই প্রকৃতির ই একটা অংশ। যদি সেই উদারতার ছিঁটেফোঁটা ও আমরা পেতাম তাহলে পৃথিবী হয়তো আজ অন্য রকম হতো..!? 

ফরিদ তালুকদার
টরেন্টো, কানাডা।