লেখক ড. মীজান রহমান এবং আশ্রম – কবির চৌধুরী
আগামী ৫ই জানুয়ারি ২০২০ উত্তর আমেরিকার পাঠকনন্দিত লেখক ড. মীজান রহমানের ৫ম মৃত্যুবাষিকী। ২০১৫ সালের ঐ দিনে তিনি অটোয়া সিবিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি উপলক্ষে তাঁর প্রিয় পত্রিকা “আশ্রম” লেখকের সাহিত্যকর্ম ও যাপিত জীবন নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। লেখকের সাথে আশ্রমের সম্পর্ক ছিল আত্মার। আমার মনে পরে, অটোয়াতে যখন লেখককে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন তিনি বলেছিলেন- “বাপুরা, অটোয়াতে “আশ্রম” ছাড়া আর কারও দেওয়া সংবর্ধনা আমি নেব না।” “আশ্রম” সেই গুরুদায়িত্বটি পালন করেছিল। তাঁর এই একটি কথাতেই বুঝা যায় তিনি “আশ্রম”কে কতটুকু ভালবাসতেন। বিশেষ করে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। আমি তাঁকে আমার দীক্ষাগুরু হিসেবেই মানতাম এবং এখনও মানি। আমার বর্তমান জীবনে তাঁর এবং তাঁর লেখার প্রভাবটা খুব বেশি। তাঁর লেখার প্রভাব আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, একসময় আমি অটোয়া থেকে “মাসিক আশ্রম” প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত হই। এমন কি পত্রিকার নাম “আশ্রম” রাখা তাঁর একটি লেখার কাহিনীকে কেন্দ্র করে।
লেখক ড. মীজান রহমান এর লেখার সাথে আমার পরিচয় নব্বই দশকের শুরু থেকেই। অটোয়া থেকে প্রকাশিত 'মাসিক বাংলাদেশ' এবং টরন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'দেশ বিদেশে'র মাধ্যমে। আমার মত অসংখ্য পাঠক মীজান রহমান এবং তাঁর লেখার ভক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ তাঁর লেখার বিষয়বস্তু আর লেখনি। এর সত্যতা পাওয়া যায়, ২০১১ সালে লেখক মীজান রহমানের ৭৯তম জন্ম দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত আশ্রম এর বিশেষ সংখ্যায় অটোয়ায় বসবাসকারী রাশেদ নবীর “মীজান রহমানের অ্যালবাম ও প্রবাসী বাঙালি” এবং মহসীন বখতের “মীজান রহমান, এই বিশ্ব-ভূগোলে বঙ্গজনের সখা”প্রবন্ধে।
রাশেদ নবী লিখেন-
“ অ্যালবাম মীজান রহমানের একটি গ্রন্থের নাম---সাধারণ, কিন্তু প্রতিকী ও অর্থবহ। আমাদের প্রত্যেকের একটা পারিবারিক অ্যালবাম থাকে। আমরা সেই অ্যালবামে আমাদের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্ত ধরে রাখি। ক্রমে সামান্য এক ছবির অ্যালবাম আমাদের কাছে একটা মূল্যবান পারিবারিক সংগ্রহ হয়ে ওঠে। মীজান রহমানের প্রতিটি রচনা অনুরূপ আমাদের প্রবাসী বাঙালি জীবনের এক একটি মুহূর্ত। আমরা যখন সেই মুহূর্তগুলি অতিক্রম করি, তখন তার তাৎপর্য অনুভব করি না। কিন্তু যখন সেই মুহূর্তগুলি বিধৃত হয় মীজান রহমানের রচনায়, বা যখন সেই মুহূর্তগুলি সজ্জিত হয় মীজান রহমানের গ্রন্থে, তখন আমাদের অতীত পুনরায় মূর্ত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ তা পাঠ করে আবেগে তাড়িত হয়, কেউ কেউ তা পর্যালোচনা করে নিজের ভুল শোধরাতে চায়, আর কেউ কেউ তা ধারণ করতে না পেরে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে”।
মহসীন বখত লিখেন-
“বিপুল প্রবাসী পাঠককুল মীজান রহমানের লেখায় নিমজ্জিত। তাঁর লেখা পাঠের জন্যে তৃষিত ব্যাপক অনাবাসী বাঙালি। এটা কোন রহস্য নয়। বলা যায়, নাড়ীর টান। তাঁর আখ্যান-মঞ্জুরী আত্মজৈবনীক হলেও নিছক আত্মমগ্ন নয়। তাঁর লেখা প্রায় অজ্ঞাতবাসে প্রবাসী মনকে করে স্বপ্নমুখর, আকুল। লেখক মীজান রহমানের লেখায় দর্পিত হয় তাঁর আপন অস্তিত্ব দর্শন। দুর্লভ মোহের সন্ধানরত মানুষের মোহমুক্তিও ঘটে তাঁরই লেখার প্রীতিভাস্যে। গ্লানি মোচনের দিশা খুঁজে পায় বিপুল বিভূঁইবাসী অভাজন তাঁর লেখায়। কারও মুছে যায় অহেতুক অহংবোধ। মানবতাবোধের কাছে নত হয় অনেক দুরাত্মা-ব্যক্তিসত্ত্বা। মীজান রহমানের লেখা পাঠ কোনো অ্যাডভেঞ্জার বা রোমাঞ্চতৃষ্ণার নিবারণ নয়। আত্মনিগ্রহ থেকে বেরিয়ে আসার আলোকিত রন্ধ্রপথের দেখা পাওয়া যায় তাঁর প্রতিটি লেখা বা আখ্যানে। একজন লেখকের সাফল্য আর কি হতে পারে? আজ তাঁর মনীষায় নিবদ্ধ অগণিত পাঠককুল। মানুষের অচেতন ইচ্ছাশক্তি জাগিয়ে তুলতে মীজান রহমানের লেখার জুড়ি হয়না”।
ড.মীজান রহমান এর জন্ম ঢাকায়। ১৯৩২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডনের কেমব্রিজ ও কানাডার নিউব্রান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউ ব্র্যান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার পর সেখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে অটোয়ার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে গেছেন। গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান তাঁর বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে গণিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে ফলিত গণিতে এম এস সি করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান লন্ডন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। লন্ডনের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর চলে আসেন কানাডায়।
ড.মীজান রহমান এর লেখালেখির শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে। লক্ষীবাজারের মতিভাই রেস্টুরেন্টে, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখদের সাথে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। ফজল শাহাবুদ্দিন ও শামসুর রাহমান সম্পাদিত “কবি কন্ঠ”-এ আনোয়ার মীজান নামে কবিতাও লিখেছেন। পড়াশোনার ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে লেখালেখির আগ্রহ কমে যায় এবং একসময় তা বন্ধ হয়ে পড়ে। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল। তাঁর লেখালেখিতে ফিরে আসার অন্যতম মাধ্যম অটোয়ার তথা কানাডার প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের জাতক “বাকাওভ” এর একটি স্মরণিকা এবং অটোয়া থেকে প্রকাশিত 'মাসিক বাংলাদেশ'। সেই যে শুরু হয়েছিল আর থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন।
১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম বাংলা গ্রন্থ 'তীর্থ আমার গ্রাম' প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি, 'লাল নদী' (২০০১), 'অ্যালবাম' (২০০২), 'প্রসঙ্গ নারী' (২০০২), 'অনন্যা আমার দেশ' (২০০৪), 'আনন্দ নিকেতন' (২০০৬), 'দুর্যোগের পূর্বাভাস' (২০০৭), 'শুধু মাটি নয়' (২০০৯), 'ভাবনার আত্মকথন' (২০১০), 'শূন্য' (২০১২) এবং অভিজিৎ রায়ের সাথে 'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব' (২০১৫)। এছাড়া তিনি ১৯৯০ George Gasper এর সাথে মিলে Basic Hypergeometric Series নামে বইটি রচনা করেন।
চলার পথে দেখা যায় অধিকাংশ মানুষই জীবন-সংসারের প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আটকে গেছেন। ড. মীজান রহমান ছিলেন তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, এবং সমাজের জন্যে কাজ করে গেছেন। জীবদ্দশায় নিয়মিতভাবে লিখে গেছেন আশ্রমসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়। লেখক ড. মীজান রহমানের সংস্পর্শে জীবনের কিছুটা সময় কাটিয়েছি বলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়।
বিঃদ্রঃ এই লেখার মাধ্যমে আমি অটোয়াসহ অন্যান্য শহরের মীজান ভক্তদের আশ্রম আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্যে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। স্থানঃ Take Out King Restaurant, 286 Bank street, Ottawa. তারিখঃ 5th January, 2020. সময়ঃ 4-00pm to 6-00pm.
কবির চৌধুরী । অটোয়া
-
নিবন্ধ // মতামত
-
04-12-2019
-
-