বাঙালির শেকড় (শেষ পর্ব) - আলম তৌহিদ
পান্ডুরাজার ঢিবি খনন থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনগুলো ও অন্যান্য আবিষ্ক্রিয়া আমাদের জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধিতে দারুণ সহায়তা করেছে। পান্ডুরাজার ঢিবিতে আমরা চারটি যুগের নিদর্শন পাই। ফলে রাঢ় অঞ্চল যে অতি প্রাচীন ভূমি, এখানকার লোকবসতি যে সুপ্রাচীন তা নিশ্চিতভাবে স্বীকৃতি পেল। অনেক গবেষক মনে করেন পাণ্ডুরাজার সভ্যতা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সঙ্গে তুলনীয়।
বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পাথুরে হাতিয়ার থেকে এই ধারণা করা যায় যে প্রত্নপ্রস্তর, নবপ্রস্তর, তাম্রাশ্ম বা ব্রোঞ্জযুগেও অন্তত রাঢ় অঞ্চলে জনবসতি ছিল। নবপ্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে কৃষি ও বয়নশিল্পের উদ্ভব হয়। তখন থেকে পশুপালন ও যাযাবর জীবনের আভাস পাওয়া যায়। এ সময়ে তারা মৃতব্যক্তিকে কবরস্থ করত এবং খাঁড়া লম্বা পাথর বসিয়ে কবর চিহ্নিত রাখত। বীরকাঁড় নামের এই খাঁড়া পাথর মেদিনীপুর, হুগলী ও বাঁকড়াতে দেখতে পাওয়া যায়।
ব্রোঞ্জযুগেই বাংলার কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। পাণ্ডুরাজার ঢিবির সঙ্গে মহাভারতীয় পাণ্ডবদের সম্পর্ক থাক বা না থাক আমরা মোটামুটি ভাবে আজ থেকে চার হাজার বছর পূর্বের রাঢ়বাসীর কিছু তথ্য পাচ্ছি। বাংলাদেশে উচ্চবিত্তের বর্ণের শ্রেণী হচ্ছে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ। অন্য সবাই নির্দিষ্ট বৃত্তিজীবী। গুপ্ত আমলে রাজশক্তির প্রয়োজনে অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ বাংলায় আসে। তারা বৈদিক যজ্ঞের পৌরহিত্য জানত না। তাই বল্লাল সেনের রাজত্বকালে বৈদিক ব্রাহ্মণ আনা হয় বাংলায়। তাদের অনুচর বা ভৃত্য হিসেবে আসে ঘোষ, বসু, মিত্র, দত্ত প্রভৃতি বর্ণের লোক। দত্তরা কারো ভৃত্য হিসেবে নয়, সঙ্গী হিসেবে এসেছিল। বাংলায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য কখনও ছিল না। বাংলায় ব্রাহ্মণের সংখ্যাধিক্যের আলোকে বিচার করলে মেল-পট বিন্যাসের সময়ে দেশী লোকও ব্রাহ্মণ-বৈদ্য হয়েছে বলে মানতে হবে। দাক্ষিনাত্যের অনার্য অবয়বের ব্রাহ্মণদের কথাও এসুত্রে স্মরণযোগ্য। বাংলায় বৌদ্ধ বিলুপ্তির সুযোগে সেন আমলে ক্ষত্রিয় বর্ণ-বিন্যাসের ফলে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ সমাজ গড়ে ওঠে যার জের চলে সতেরো শতক অবধি।
নৃবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বাংলার জনগণের মধ্যে বৈদিক আর্যভাষীর রক্ত কিংবা দৈহিক কাঠামো কোনটির অস্তিত্ব নেই। এক্ষেত্রে কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর সিদ্ধান্তকে সত্য হিসেবে স্বীকার করা যায়। তাদের মতে বাংলার উচ্চবর্ণের লোকগুলো (ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ) আর্যভাষী আল্পীয় এবং অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের পরে সমুদ্রপথে এরা বাঙলা ও উড়িষ্যায় প্রবেশ করে। কালক্রমে এরাই প্রভুত্ব করতে থাকে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের উপর। এদের জীবিকা ও সেবার প্রয়োজনে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের মধ্য থেকে যাদের সেবক হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তারাই হচ্ছে সৎশূদ্র ও সদগোপ। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে তাদের কথা উল্লেখ আছে। তারা অস্পর্শ্য ছিল না। তারা ছিল স্পর্শযোগ্য বা জলাচারযোগ্য নির্দিষ্ট পেশার ও প্রশ্রয়ের অস্ট্রিক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষ। বাঙলার বাকি জনগণ রইল নির্দিষ্ট হীনবৃত্তজীবী রূপে, চিরনিঃস্ব ও অস্পৃশ্য হয়ে। যারা অন্ত্যজ রূপে পরিচিত। সম্ভবত বৌদ্ধযুগে নিম্নবৃত্তির নিম্নবর্ণের বৌদ্ধরা তেমন অস্পৃশ্য ছিল না।
বাংলায় বৌদ্ধ বিলুপ্তির পর থেকেই অস্ট্রিক-দ্রাবিড় নরগোষ্ঠী তথা আদি বাঙালির দারিদ্র্যের সঙ্গে সামাজিক ঘৃণা ও দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। আল্পীয় আগ্রাসনে যারা সমতল ছেড়ে আরণ্যক হয়, তারা কোল-ভীল-মুন্ডা নামে আজো গোত্র স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করছে উপজাতি অভিধায়। হাড়ি-ডোম-মুচি-মেথর-চন্ডাল-শবর-কাপালি-বাগদি প্রভৃতি গোত্রের লোকেরা হচ্ছে তাদের নিবৃত্তি-নিঃস্ব জ্ঞাতি। এরা ছিল দাস ও হীনকর্মের লোক। মোঙ্গলীয় গোত্রের নরগোষ্ঠীরা ছিল তাদের কাছে ম্লেচ্ছ। বৌদ্ধযুগে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের মধ্যে সদগোপ কৈবর্তরা এবং মধ্যযুগে মল্লরা বাহুবলে কোথাও কোথাও স্থানিক প্রাধান্য লাভ করে। এক্ষেত্রে দিব্যক-রুদ্রক-ভীম কিংবা ইছাই-সোম-ঘোষ অথবা মধ্যযুগে রাঢ়ের মল্লারদের কথা স্মরণ করতে পারি।
এখানে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পান্ডুরাজার ঢিবি-সভ্যতার স্তর অতিক্রম করার আগেই এখানকার বাংলাভাষী অঞ্চলে জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য মতবাদ প্রচারিত হতে থাকে এবং বাংলাদেশ পরবর্তী দুই হাজার বছর ধরে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের করায়ত্ব থাকে। দুই হাজার বছর ধরে পরাধীনতার গ্লানীতে নিমজ্জিত বাঙালির স্বসত্তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার কিংবা আত্মবিকাশের কোন সুযোগ ছিল না। মৌর্য-শুঙ্গ-কাহ্ন-শক-কম্ব-গুপ্ত-পাল-সেন-তুর্কী-মুঘল-বৃটিশ প্রভৃতি শাসকগণ ছিলেন বিদেশী-বিজাতি। তাদের প্রশাসনিক শাসন-শোষণে, শাস্ত্রিক-সংস্কৃতিক আগ্রাসনে স্থানীয় লোকেরা সমষ্টিগতভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বর্মণ, চন্দ্র, খড়গ, গুপ্ত, দেব প্রভৃতি ক্ষুদ্র স্বাধীন সামন্ত ও আঞ্চলিক রাজারাও বাঙালি ছিল না। দেশের আদি অধিবাসী ও প্রকৃত মালিকরাই সামন্ত প্রভুদের প্রবল প্রতাপে সেবাদাস রূপে মানবিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে কোন প্রকারে জীবন গুজার করেছে। এসব সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে কিছু আল্পীয় নরগোষ্ঠী ও কিছু বুদ্ধিমান যোগ্য অস্ট্রিক-দ্রাবিড়ও ব্যক্তিগতভাবে প্রভুগোষ্ঠীর প্রয়োজনে উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হবার সুযোগ রাজনৈতিক নিয়মেই লাভ করেছিল। সময়ের পরিক্রমায় বর্ণবিন্যাসের কালে তারাও উচ্চতর বণিক স্তরে ওঠেছে। তাই আজকের বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে বর্ণবাদের বহুলতা প্রত্যক্ষ করছি। মোটকথা বাঙালির সামাজিক বিবর্তন-উন্নয়ন চলেছিল বিদেশী ভাষা-শাস্ত্র-সংস্কৃতি শাসনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে। তাই বাঙালির চিন্তা-চেতনায়, জীবন-জিজ্ঞাসায় এবং জগত ভাবনায় একটি অদৃশ্য স্বাতন্ত্র্য ও মৌলিকতা থাকলেও আসলে তার সবকিছুই অনুকৃত ও বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে আহরিত। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ লিখেছেন-
“বিদেশী-বিভাষী-বিধর্মী-বিজাতির শাসন তার স্বসত্তা-চেতনার বৃদ্ধি রোধ করেছিল। বাঙালি রইল ব্রাহ্মণবাদীদের চোখে উত্তম সঙ্কর, মধ্যম সঙ্কর ও অন্ত্যজ নামের কামার-কুমার-চামার-কাঁসার-তাঁতি-হাড়ি-ডোম-জেলে-চড়াল-বাগদি-ধোপা-নাপিত-তেলী-গোপ-কেউট-ক্ষুদ্র বেণে প্রভৃতি অবজ্ঞেয় পেশাজীবী হয়ে। বাংলা-আসাম-উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ পূর্ব বিহারের অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মানুষের-দেশজ বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষের দুই হাজার বছর ধরে এই ছিল অবস্থা। বস্তুত ঊনিশ শতকের শেষ পাদ থেকেই উক্ত বিস্তৃত অঞ্চলের নির্জিত নির্যাতিত গণমানব বিরুদ্ধ পরিবেশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সামান্য সামান্য সুযোগ পাচ্ছে। বিদেশী প্রভাব ও পরাধীনতা যে আত্মবিকাশের কি দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধা দুই হাজার বছরের খাঁটি বাঙালিই তার প্রমাণ। দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় বর্গের নরগোষ্ঠী বহু বহুকাল উত্তর ভারতীয় আর্যভাষীর প্রভাবমুক্ত ছিল বলে আর্যশাস্ত্র গ্রহণ করেও তারা স্বাতন্ত্র্যে ও স্বাধিকারে স্বস্থ ছিল। রাষ্ট্রকূট-চৌল-চালুক্য-পল্লব সাম্রাজ্য ও ভাষাগুলো তার প্রমাণ।" ৪
সুতরাং বলতে হয় বাংলায় প্রচলিত শাস্ত্রিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালি নেই। ইতিহাসে যা দ্রষ্টব্য হয় তা উত্তর ভারতীয় জৈন-বৌদ্ধ- ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ও তুর্কী, মুঘল, ইংরেজদের কৃতি ও কীর্তির বিবরণ। সেই ইতিহাস পড়ে আমরা আত্মপরিচয় ভুলে গেছি, এমন কি নিজেদের জ্ঞাতিদেরও ঘৃণা করতে শিখেছি।
সত্যিকার অর্থে একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যাবে অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গল জাত বাঙালির পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের জীবন-চেতনা ও জগত ভাবনার মধ্যে। তাই বাঙালির দর্শন লুকায়িত আছে সাংখ্যে, যোগে, কায়সাধনতত্ত্বে। বাঙালিকে পাওয়া যাবে তন্ত্রে-মন্ত্রে, দারু-টোনা-বান, উচাটন, বশীকরন শক্তির চর্চায়। রজ-শুক্র চর্যায়, ডাক-ডাকিনি, যোগ-যোগিনীর মাহাত্ম্য ও প্রভাব শিকারে, তাদের কৃষিতত্ত্বে ও আবহাওয়া চেতনার মধ্যেও পাওয়া যাবে বাঙালিকে। বৌদ্ধ মতের মহাযান ও সহজযানে, লোকায়ত শাস্ত্রে ও লৌকিক দেবতার উদ্ভাবনে বাঙালি পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। বৈষ্ণব-বাউল-চৈতন্যের প্রেমবাদে, পীর-নারায়ণ সত্যের উপলব্ধিতে আর বেদে-তাঁতি-পোদ-কিরাত-নিষাদ প্রভৃতি অন্ত্যজবর্গের আচার-সংস্কারে এবং তথাকথিত উপজাতির জীবন-পদ্ধতিতে প্রকৃত বাঙালির পরিচয় মেলে। আরও বেশি বাঙ্গালিত্বের পরিচয় মেলে বাঙালি চেতনার গভীরে জগত ও জীবন ভাবনায় নারিদেবীর প্রভাব স্বীকারে, কালী, দুর্গা, চণ্ডী, মাতৃকা পুজায়, অরি দেবতা রূপে ও মনসা, ওলা, ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতি নারীদেবতা কল্পনায়। এমন কি রবীন্দ্র মানসেও জীবন নিয়ন্ত্রক হিসেবে নারীকেই পাওয়া যায় মুখ্য হিসেবে। নারী জগত নিয়ামক শক্তি ও জীবনদেবতা হিসেবে তার গানে-কাব্যে আলাদা অভিব্যক্তি পেয়েছে।
বাঙালির নিজস্ব দেবতার মধ্যে রয়েছে শিব- বিষ্ণু- ব্রহ্মা- নারী- পশু-পাথর ও বৃক্ষ দেবতা ইত্যাদি। মূর্তিপূজা, অবতারবাদ, জন্মান্তরবাদ, মন্ত্রশক্তি, কায়াসাধন, যাদুবিশ্বাস, শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, চড়ক, গাজন প্রভৃতি আচার সংস্কৃতি বাঙালির নিজস্ব। শুভকাজের যাদুর প্রতীক চাউল, খই, কলা, নারিকেল, পান-সুপারি, আম্রসার, দূর্বা, ঘট, হলুদ, দধি, মাছ, আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি ইত্যাদিও অস্ট্রিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গলজাত বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি।
অনুকৃত পরসংস্কৃতির চর্চা ও মিথ্যে আভিজাত্যের বড়াই নয়, সঠিক ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়েই প্রকাশ ও বিকাশ হতে পারে বাঙালির স্বরূপসত্তা।
আলম তৌহিদ । বাংলাদেশ
লেখক- কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার
মেইল- alamcxb053@gmail.com
তথ্যসূত্র-
১। ভারতবর্ষের ইতিহাস- (অনুবাদ) মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ১,২
২। সমাজ সংস্কৃতির স্বরূপ- আহমদ শরীফ। ৩,৪
৩। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা- শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৪। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি- গোলাম মুরশিদ
-
নিবন্ধ // মতামত
-
12-12-2019
-
-