রাশেদা নওয়াজঃ প্রবাসে বাঙালীদের অনুপ্রেরণা – সুপ্তা বড়ুয়া
রাশেদা নওয়াজ, উত্তর আমেরিকার বাঙালীদের মধ্যে অন্যতম সফল এবং প্রভাব বিস্তারকারী মানুষদের একজন। তিনি শুধু বাঙালী কমিউনিটি নয়, নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন কানাডিয়ান সমগ্র সোসাইটির জন্য, সর্বোপরি নতুন অভিবাসীদের জন্য। এরকম একটি ছোট্ট নিবন্ধে রাশেদা নওয়াজের বর্ণাঢ্য কর্ম, সমাজসেবা এবং রাজনৈতিক জীবন তুলে আনা দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও বটে ! তবুও সকল অভিবাসীদের জন্য আলোকবর্তিকা নিয়ে আসা, রাশেদা নওয়াজের গল্প আপনাদের উপহারের প্রয়াস এই লেখাটি। আমাদের বাঙালীদের অগ্রদূত। প্রবাসে-দেশে-বিশ্বব্যাপী একজন রোল মডেল। রাশেদা নওয়াজ, একাধারে একজন প্রাক্তন সরকারী কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী। তার কর্মজীবন সাজানো কানাডার তিনটি সরকার ব্যবস্থায় উচ্চপদস্থ পদে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। Betsy McGregor-এর Women On the Ballot বইয়ে ৯০ জন রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী নারীর কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, যাদের মধ্যে জন্মগতভাবে কানাডিয়ান নারী থেকে শুরু করে অভিবাসনের মাধ্যমে কানাডার নাগরিকত্ব অর্জন করা নারীরাও রয়েছে। আর সেখানে রাশেদা নওয়াজ অন্যতম। Betsy McGregor এই ৯০ জন নারীকে কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে Trailblazer বলে আখ্যায়িত করেছেন, কিন্তু কেন তারা Trailblazer?
রাশেদা নওয়াজের কর্ম, সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড আর রাজনৈতিক জীবন একটুখানি পর্যালোচনা করলেই সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় পরিবারে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাশেদা নওয়াজের। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার বরুথান গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান বাবা, আইনজীবী নূর-উল আলম খান, ময়মনসিংহের ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার অফ ফুড হিসেবে ১৯৪৬ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। খুলনা ডিভিশনের রিজিওনাল কন্ট্রোলার এবং পরবর্তীতে অন্যান্য উচ্চপদেও আসীন হন। তিনি অত্যন্ত উদার আর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানদের তৈরি করেছিলেন। মা গৃহকর্ত্রী, আঞ্জুমান আরা বেগম, অত্যন্ত দৃঢ় এবং ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষ ছিলেন, অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করেন নি। দৃঢ় এবং স্বাধীনচেতা হিসেবে রাশেদা নওয়াজের অনুপ্রেরণা তার মা'ই। রাশেদা নওয়াজের পরিবারের অনেক সদস্যই হয় মুক্তিযোদ্ধা নয়তো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। মূলত পারিবারিকভাবে এমন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠাকে তিনি তার সৌভাগ্য মনে করেন, এসব ঐতিহ্যের সূত্রেই রাশেদা নওয়াজের গন্তব্যই ছিলো বোধয় একজন অসাম্প্রদায়িক, রাজনীতি সচেতন, জনসেবায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকারী হিসেবে গড়ে ওঠা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জড়িত ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সাথেও।
১৯৭০-এ বিয়ে হয় স্থপতি তানবীর নওয়াজের সাথে আর ১৯৭৩ সালে স্বামীর সাথে পাড়ি জমান প্রবাসে৷ অত্যন্ত প্রথিতযশা স্থপতি তানবীর নওয়াজের পরিবারও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি পরিবার। এমন একটি পরিবারে বিয়ে হওয়ার পরও, শুধু স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকতে চান নি তিনি, নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছিলেন। স্বামী তানবীর নওয়াজেরও পেয়েছেন আকুন্ঠ সহযোগিতা, সমর্থন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফি’র উপর মাস্টার্স করেন কৃতিত্বের সাথেই। তারপর ১৯৭৩ সালে কানাডা এসেই দু'বছরের জন্য মাস্টার্স করেন Urban & Regional Planning-এর উপর টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। Regina-তে Saskatchewan Urban Affair-এ Principal Planner হিসেবে কাজ করার সময় সমাজসেবামূলক কাজেও আস্তে আস্তে জড়িত হতে শুরু করেন। সমাজসেবামূলক কাজের সূত্রেই অভিবাসী নারীদের প্রবাসের দূর্বিষহ-একাকী জীবনের কারণে হতাশায় ভোগার মর্মবেদনা অনুভব করেন আর এ থেকেই নারীদের কিভাবে মূল ধারায় সংযুক্ত করা যায় তার ব্যবস্থা করেন ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং-এর মাধ্যমে, যা বহুজাতিক অভিবাসী (যারা মূলত নিজ দেশেও অনেক সাবলম্বী ছিলেন) নারীদের জন্য একটি মাইলফলক, যার ফল সুদূরপ্রসারী। বরাবরই কাজ করে এসেছেন এই অভিবাসী জনসমষ্টিকে কিভাবে কানাডা কাজে লাগাতে পারে নানা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে। অভিবাসী নারীদের জন্য ‘Language training' তারই একটি নমুনা।
যথাক্রমে কানাডার প্রাদেশিক, নগর এবং কেন্দ্রীয়, তিন পর্যায়ের সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাশেদা নওয়াজের জীবন। অটোয়া সিটির নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে যে সাসটেইনেবল প্ল্যানিংটি (টেকসই নগর পরিকল্পনা) উনি উপস্থাপন করেন, সেটির মূল প্রতীপাদ্য ছিলো, পরিবেশকে কিভাবে গুরুত্ব এবং রক্ষার মাধ্যমে নগর উন্নয়ন প্রয়োজন এবং সম্ভব। Plan Canada জার্নালের নভেম্বর ১৯৯১ সালের সংখ্যায় উনার এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়। অটোয়া সিটি প্ল্যান বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় শহরেরও উন্নয়নের রূপরেখায় রূপান্তরিত হয়। গবেষণাপত্রটির মতে নগর ব্যবস্থা হবে, ‘An approach to managing urban development which balances the rights of the individual and the needs of society with the need to conserve our natural resource base and enhance the natural environment, thereby promoting the health of Ottawa's inhabitants and communities'! ফলশ্রুতিতে, রাশেদা নওয়াজের ডাক পড়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানব্যারা, চায়নার সাংহাই, বালি দ্বীপ ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন, জ্যামাইকা, বারবাডোসের মতো শহরের City Planner Conference -এ Plannery Speaker হিসেবে অংশগ্রহণের, ইংল্যান্ডের গ্লোবাল ফোরামে অন্যতম বক্তা হিসেবে। CIDA-তে কাজ করার সময় জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট কমিশনে কানাডার প্রতিনিধিত্বও করেন তিনি।
২০০৪ সালে রাশদা নওয়াজ আরেকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের Urban and Community Studies-এর International Conference-এ, Right to Shelter নামে, যেটি google-সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। গবেষণাপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, “Shelter is more than a roof over head……….A place to come back to- a place to call home and a place to have a family life”! জনসেবামূলক কাজের ধারাবাহিকতায় বার বার মানুষের জীবনের মান উন্নয়নের কথাই বলে যান তিনি।
কানাডা-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত Journal of Sustainable Development-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময় Environment Management in Bangladesh, Women in Sustainable Development ইত্যাদি নামে কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন। Women in Sustainable Development সাময়িকীতে তুলে সেখানে ধরেন নারীদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা আর সমাধানের গল্প। সাময়িকীর মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন একজন সাধারণ বাঙালী নারী আর একজন কানাডিয়ান নারীর চাহিদা মূলত একই, ‘Just to live with dignity, able to support myself and my children & that's all'। কেন এবং কিভাবে নারীবান্ধব একটি সমাজ তৈরি জরুরী তার প্রয়াস ছিলো সাময়িকীতে। রাশেদা নওয়াজের বলে যাচ্ছিলেন সেই কথা, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর হওয়া অত্যন্ত জরুরী, তার নিজের জন্য এবং সমাজের জন্য।
রাশেদা নওয়াজ ২০১৫ সালে কানাডায় ফেডারেল ইলেকশনে লিবারেল পার্টি থেকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত একজন প্রার্থী (QNC) ছিলেন , তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা স্বত্তেও উনি জয়লাভ করতে পারেন নি। যদিও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন নি, তথাপি তার এই অভিজ্ঞতা আর সাফল্য এতদূর আসার, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আমাদের বাঙালীদের জন্য। এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে রাশেদা নওয়াজ উপলব্ধি করেন, সাধারণ জনগণ ভোট দিলেও নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশেষ জ্ঞাত নেই, নতুন প্রজম্মকেও এ ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা হয়। কিভাবে সদস্য সংগ্রহ করতে হয়, কিভাবে স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং দিতে হয়, কিভাবে সাধারণ জনগণের কাছে এসব বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করতে হয়, এই পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে গিয়েছে প্রায় ১০০ স্বেচ্ছাসেবী। আর এসব স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে একজনও যদি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা পায়, সেটিকেই রাশেদা নওয়াজ মনে করেন তার সাফল্য। উনি হেরেও দল থেকে নির্বাচিত প্রার্থীকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দেন এবং পাশাপাশি দেশ এবং জাতির স্বার্থে রাশেদা নওয়াজ তার সকল সমর্থককেও আহ্বান জানান মূল নির্বাচনে যেন তারা দল থেকে নির্বাচিত প্রার্থীকেই সমর্থন করেন। এমন উদার রাজনৈতিক মনমানসিকতা সবার জন্য অনুকরণীয় বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল সময়ে।
কানাডার মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন জানতে চাইলে, রাশেদা নওয়াজ বলেন, “আসলে অনুপ্রেরণা তো একদিনে আসে না বা একটা কোন নির্দিষ্ট ঘটনায় আসে না”। বছরের পর বছর পার্টির সাথে কাজ করতে করতে মূলত জনসেবাই পরিণত হয়েছে উনার ধ্যান জ্ঞানে। বার বার কেন এবং কিভাবে অভিবাসীদের মূলধারায় সংযোগের প্রয়োজন সেই কথা বলছিলেন, আরো বলছিলেন নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে বড় করে তোলার কথা। কথার সূত্রে উল্লেখ করতে ভোলেন না অভিবাসী নাগরিকদের মূল ধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। «আমরা যদি মূলধারার সাথে সংযুক্ত না হই, তাহলে অভিবাসীদের মূলত কি ধরণের সমস্যা এবং তার সমাধানে কি ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা কখনোই তুলে ধরতে পারবো না” । তার এইরূপ আরো বিভিন্ন উদ্ধুদ্ধমূলক বক্তব্যও সবার সাথে আলোচনা করেন ২০১৯ সালের একটি টকশো Women of Influence-এ।
রাশেদা নওয়াজের অর্জনগুলো দেখে মনে হতেই পারে উনি কেবল মাত্র সম্পৃক্ত ছিলেন কানাডিয়ান মূলধারার সাথে, বরং তার উল্টো। মূলধারার কানাডিয়ান রাজনৈতিক জীবনে জড়িত থেকেও পাশাপাশি বাংলাদেশী কমিউনিটিরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন সমান দক্ষতার সাথে। তিনি উল্লেখ করেন, দুই টার্মে ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত বাকাওভের সভাপতি ছিলেন। এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী হিসেবে ১৯৯৩ সালে ফোবানার পক্ষ থেকে Outstanding Achievement Award পুরষ্কারে ভূষিত হন। গতবছর, ২০১৯ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬শে মার্চকে City of Ottawa-র পক্ষ থেকে Bangladesh Day হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পেছনে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রাশেদা নওয়াজ।
রাশেদা নওয়াজের এত এত সাফল্যের পরও দুঃখ করে বলেন, “৩০ বছরের কর্মময় জীবন কাটিয়েছি, অভিবাসীদের মূলধারায় সংযুক্ত করতে। কিন্তু ইদানীং আবার যেই কি সেই পুরানো ধারাতেই যেন ফিরে যাচ্ছে এক একটি অভিবাসী দল। নিজেদের দেশের-সংস্কৃতির মানুষদের ছাড়া কারো সাথেই মিশছে না। এক একটা ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে সবাই যার যার মতো নিজেদের পরিচিত পরিমন্ডলেই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে”। তাই পরিশেষে একটা কথাই রাশেদা নওয়াজ উল্লেখ করেন, যেখানেই যাই না কেন আমরা আমাদের শেকড়ের কথা হৃদয়ে ধারণ করে মূলধারার কর্ম-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে সম্পৃক্ত হবো, পাশাপাশি রাজনীতিতে আরো বেশি মাত্রায় অভিবাসীদের, বিশেষ করে অভিবাসী নারীদের যুক্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বর্তমানে ফেডারেল লিবারেল ওম্যান এসোসিয়েশন-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার এবং সেক্রেটারি। তাছাড়া পাশাপশি পার্টির নীতিমালা তৈরিতে ভূমিকা পালন করছেন। একটাই প্রত্যাশা রাজনৈতিক এ ব্যক্তিত্বের ‘equality and respect for all'! অগ্রিম জন্মদিনের শুভেচ্ছা রাশেদা নওয়াজকে, জয়তু রাশেদা নওয়াজ!
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
11-01-2020
-
-