অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সুখের সন্ধানে – চিরঞ্জীব সরকার

হাভারতের পঞ্চপান্ডবদের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠিরকে ধর্মরাজ বকরূপে কিছু প্রশ্ন করেন তাঁর একটি ছিল জগতে কে সুখী। যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিল, “অঋনী, অপ্রবাসী, শাকান্নে গৃহবাসী”। অর্থাৎ যার ঋন নাই, জীবিকার জন্য যার প্রবাসে জীবন অতিবাহিত করতে হয় না এবং যে শাকভাত খেয়েও নিজের ঘরে থাকতে পারে।

হিমালয়ে এক ধরনের মৃগ বা হরিণ থাকে যাকে মাস্ক ডিয়ার বলে। বছরের একটা সময় এর নাভি থেকে এক ধরনের তীব্র সুরভী বের হয়। বনের অন্যান্য প্রানীরা এ সৌরভের সন্ধান করতে করতে এ মাস্ক ডিয়ারের কাছে চলে আসে। আর এ মাস্ক ডিয়ার তাঁর নিজের শরীরেই যে এ সৌরভের উৎস তা না জেনে পাগলের মত বনের এদিক ওদিক ছুঁটতে থাকে। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে এ সৌরভের উৎস খুঁজতে খুঁজতে তা না জেনেই সে দেহত্যাগ করে। আমরাও কি মাস্ক ডিয়ারের মত সুখের উৎসের সন্ধানে কত দেশে, কত মানুষের কাছে, কত বস্তুর কাছে ছুটছি না। সুখ নামক সে মায়ামৃগ অধরাই থেকে যাচ্ছে। সুখের উৎস যে নিজের হৃদয়েই। সুখ সন্তোষেই নিহিত। ভোরের সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মি হৃদয়কে সুখে ভরে দিতে পারে যদি আমরা সেখান থেকে সন্তোষ লাভ করতে পারি নতুবা রঙিন প্রাসাদের লাখো টাকার ঝাড়বাতির রোশনিতেও আমরা সুখ পাব না যদি না সেখানে সন্তোষ থাকে।

মহারাজ যদুর খুব ইচ্ছে ছিল জানতে তার রাজ্যে কোন সুখী লোক আছে কিনা। এজন্য তিনি ছদ্মবেশে নগর, বন্দর, গ্রাম পরিভ্রমন করতেন নিজের ইচ্ছেমত। বহুবছর এরকম অনুসন্ধানের পরও তিনি কোন সুখী লোক খুঁজে পাননি। কারো মুখের দিকে একটু গভীরভাবে তাঁকালেই তিনি অনুধাবন করতে পারতেন যে কোথাও যেন একধরনের শূন্যতা বা হতাশাবোধ কাজ করছে। এরকম দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রাজা যদু যখন ধরেই নিলেন এ পৃথিবীতে সুখী মানুষ আসলেই নেই এমনি সময়ে কোন এক প্রভাতে সারা পৃথিবীর বহু নগরী, উদ্যান, শস্যক্ষেত্র, খনি, বন্দর, উপত্যকা, জনপদ পরিভ্রমন শেষে দত্তাত্রেয় নামক এক সাধু রাজা যদুর রাজ্যে প্রবেশ করেছে। দত্তাত্রেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়েই রাজা যদুর মনে হল এ সাধুর মুখে যে সুখের সমূদ্র বইছে। রাজা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো এ প্রথম আমি গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলাম আপনি এক সুখের সাগরে অবগাহন করছেন। এর উৎস বা কারন কি? উত্তরে দত্তাত্রেয় বললেন, “আমি আমার পরিব্রাজক জীবনে ২৪ জন গুরুর ( 24 Masters ) কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং সে শিক্ষা নিজের জীবনে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। রাজা যদু আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ চব্বিশজন গুরু কারা? দত্তাত্রেয় বললেন এরা হল মাটি, অগ্নি, বায়ু, পানি, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, সাগর, মৎস্য, মৃগ, মৌমাছি, মধুহরনকারী ব্যক্তি, তীরন্দাজ, হস্তী, সর্প, অজগর, কপোত,  চিল, পিঙ্গলা (বিদেহ নগরের সবচেয়ে আকর্ষনীয়া পতিতা), শিশু, কুমারীকন্যা, মাকড়সা, পতঙ্গ এবং কাঁচপোকা। সবগুলো নিয়ে আলোচনা করব না। দু’একজন গুরুর কাছ থেকে দত্তাত্রেয় কি শিক্ষা নিয়েছেন তা দেখা যাক।

মধুহরনকারী ব্যক্তিঃ মৌমাছি কত কষ্ট করে ফুলে ফুলে ঘুরে মৌচাকে মধু রাখে। হঠাৎ কোন এক ব্যক্তি এসে তাঁর সব মৌ হরন করে নিয়ে যায়। পার্থিব জীবনে কত কষ্ট করে আমরা ধন জন সংগ্রহ করি। কিন্তু যে কোন সময় কোন এক বিপর্যয় এসে তা হরন করে নিতে পারে। ধন জন সংগ্রহ দোষের কিছু নয় কিন্তু এতে মাত্রতিরিক্ত আসক্তি দোষের। কোন এক বিপর্যয় হঠাৎ না আসলেও মৃত্যু এসে যে কোন সময় এগুলো হরন করে নিবে। এ চিন্তা মাথায় থাকলে আমরা এগুলোর পিছনে এত বেশি ব্যাকুল হব না, না পেলেও ক্ষুদ্ধ হব না আবার পেয়ে হারালেও তেমন একটা ব্যথিত হব না। সুখী মানুষের এ রকম চেতনা থাকে।

পিঙ্গলাঃ পিঙ্গলা বিদেহ নগরীর নামকরা পতিতা ছিল। যথারীতি একদিন সন্ধ্যায় সে নিজেকে বেশভূষায় সাজিয়ে নিজ গৃহের বাইরে নগরের রাজপথে দাঁড়িয়ে ছিল খদ্দেরের অপেক্ষায়। প্রতিদিন তাঁর খদ্দেরের কোন অভাব হয় না। কিন্তু আজকে অনেক রাত অতিক্রম হলেও কেউ তাঁর প্রতি আকর্ষন বোধ করছে না। কয়েকবার সে বেশ পরিবর্তন করল। গৃহে এসে আয়নায় নিজেকে দেখলেন। তাঁর রূপ কি ঝরে গেছে। নিজেকে প্রশ্ন করল। না সবকিছুতো ঠিকই আছে। তাহলে আজকে এমন হচ্ছে কেন? রাত বারটা পর্যন্ত অপেক্ষমান থেকে চরম হতাশা নিয়ে সে যখন গৃহে ফিরল তখন চরম নৈরাশ্যে পিঙ্গলা আলোকিত হয়ে গেল। ঐ দিনই পিঙ্গলা ঠিক করল সে আর এ জঘন্য পেশায় থাকবে না। অপরের করুনার উপর নির্ভর দুঃখের উৎস। পিঙ্গলা ভাবল পৃথিবীর অগনিত লোক কতভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে আর আমার জীবনের জীবিকার কি একটাই উপায়। সেদিন রাত্রে পিঙ্গলা গভীর আনন্দে ও সুখে নিদ্রা গিয়েছিল ও পরবর্তী দিন থেকে স্রষ্টার আরাধনায় জীবনকে নিয়োজিত করেছিল। নৈরাশ্য মানুষকে কখনো কখনো আলোকিত করে। জীবন নিয়ে ভাবতে শিখায়। জীবনের অনুভূতিগুলিকে আলোড়িত করে। এ আলোড়ন মানুষর চেতনাবোধকে শানিত করে যা দেয় এক অনাবিল আনন্দ ও সুখ।

তীরন্দাজঃ দত্তাত্রেয় যখন তাঁর পরিব্রাজক জীবনে কোন একটা দেশের এক সমৃ্দ্ধ নগরীতে প্রবেশ করলেন তখন দেখতে পেলেন মহাসারম্বড়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে হাতি ঘোড়া সহ  সেদেশের রাজার অভিষেক উপলক্ষে একটি বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা যাচ্ছে। নগরের কৌতুহলী জনতা ভিড় করেছে এ শোভাযাত্রা দেখতে। চারদিকে শুধু কোলাহল। মনে হচ্ছে সারা নগর যেন উৎসবে মেতেছে। এ শোভাযাত্রা একটা সময়ে তীর তৈরি করে এমন একটা দোকান অতিক্রম করছিল যেখানে বসে গভীর অভিনিবেশ সহকারে একজন তীরন্দাজ তীর বানাচ্ছিল। বাইরে এত শব্দ কোলাহল হচ্ছে কিন্তু দোকানের ভিতর তীরন্দাজ তাঁর কাজে এতই নিমগ্ন ছিল যে সে একবার এদিকে ফিরেও তাঁকাননি। তাঁর কাজের প্রতি একাগ্রতার কারনে সে তখন বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এখানের শিক্ষাটি হল নিজের কাজে আন্তরিকতার সাথে লেগে থাকলে বহিঃজগতের আঘাত থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।

চিলঃ একটা ছোট চিল এক টুকরো ছোট মাংসের টুকরো নিয়ে আকাশে উড়ছিল। হঠাৎ অনেকগুলি বড় চিল এসে ছোট চিলটাকে আক্রমন করল ঐমাংসের টুকরোটকু ছিনিয়ে নিবার জন্য। ছোট চিলটিও আপ্রান চেষ্টা করছে তাঁর মাংসটুকু প্রানপনে ধরে রাখতে। আকাশে চলছিল ধস্তাধস্তি। অনেকগুলি বড় চিলের সাথে লড়াই করে সে হয়রান হয়ে যাচ্ছিল। এময় সময় ছোট চিলটি তাঁর ঠোটের মাংসের টুকরোটিকে ছেড়ে দিল আর বড় চিলগুলি আকাশ থেকে পড়তে থাকা সে মাংসখন্ডটির দিকে ধাবমান হল। ছোট চিলটি মুক্তির আনন্দে আকাশে আবার ডানা মেলে উড়তে লাগল। জটিল পরিস্থিতিতে অনেকসময় দাবি ছেড়ে দিতে হয়, নিজের মুক্তি বা সুখের জন্যই।

সুখ ক্ষনস্থায়ী ও এর বিপরীতে দুঃখ লুকায়ে থাকে। সুখের অস্তিত্ব বস্তুর উপর নির্ভর করে। গরমকালে ঠান্ডাপানি খুবই সুখকর আবার একি ঠান্ডাপানি শীতকালে অসহ্যকর। অথচ একি পানি স্থান ও সময় সাপেক্ষে সুখ ও দুঃখ দিচ্ছে। তা কোন বিশেষ সময়ে বা পরিস্থিতিতে কোন কোন বস্তু বা ব্যক্তি কখনো সুখকর বা কখনো দুঃখকর বলে প্রতিভাত হয়। অবিমিশ্র সুখ আগেও ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। তবে আনন্দের উৎস হৃদয়। সেখানে অবগাহন করা যায় অনায়াসে যে কোন সময়ে, যে কোন পরিবেশে।

দুঃখ যদি কোন প্রচেষ্টা ছাড়া এসে সকলের দ্বারে উপস্থিত হয় তাহলে সুখও অবশ্যই কোন প্রচেষ্টা ছাড়া উপস্থিত হয়। এর জন্য আলাদা প্রচেষ্টার দরকার হয় না। কারন সুখ ও দুঃখ মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ।পার্থক্য হল দুঃখের অ্যান্টিনাগুলো আমরা সবসময় অন্ করে অ্যাকটিভ রাখি তাই সে সিগন্যালগুলো আমাদের কাছে ধরা পড়ে। কিন্তু সুখের অ্যান্টিনাগুলো আমরা অফ্ করে রাখি তাই বুঝতে পারি না কিভাবে সুখ ভেসে যাচ্ছে আমাদের জীবনের প্রতি প্রবাহে। প্রতিদিন সূর্য উদিত হয়, অস্ত যায়, বায়ু প্রবাহিত হয়, জলস্রোত সমূদ্রে ধাবমান, ঘাস ফড়িং নাচছে গৃহের আঙ্গিনায়, প্রজাপতি ডানা মেলে দুলছে নরম ফুলের পাপড়িতে, কচি পাতায় গাছ ছেয়ে যাচ্ছে, শিশু আনমনে দৌড়াচ্ছে, সুস্থ নিরোগ শরীর-এগুলো কি সুখের অনুসঙ্গ নহে?

চিরঞ্জীব সরকার । অটোয়া, কানাডা