অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আমাদের অসহিষ্ণু সমাজ (চতুর্থ) – সুপ্তা বড়ুয়া

কিছুদিন আগের একটা লেখায় লিখেছিলাম, স্বাধীনতা শব্দটা নিয়ে বারে বারে আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। কি আশ্চর্য ব্যাপার, অনেক আগেই আমার মতো এ শহরেই ড. মীজান রহমানও সন্দিহান ছিলেন, কিংবা তার ‘দুর্যোগের পূর্বাভাষ’ বইটি পড়তে পড়তে আমিও তার মতো আরো সন্দিহান হয়ে পড়ছি। ‘একাত্তরে কারা জিতেছিলো এই প্রশ্ন কোনোদিন মনে পীড়া দেবে ভাবিনি। এখন দিচ্ছে, প্রতিদিন পীড়া দিচ্ছে। একাত্তরে তারাও হারেনি, আমরাও জিতিনি। তারা পশ্চাদপসরণ করেছিলো মাত্র’। আর তার এই কথার সাথে এর চেয়ে বেশি মাত্রায় সহমত হতে পারছি না। সত্যি কি আমরা স্বাধীন ?

বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস এলেই, আমার মনে হতাশাটা বেড়ে যায়। সত্যিই পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিলো, আমাদের দেশের অগ্রগতি ঠেকাতে হলে কোথায় আঘাতটা করতে হবে। তাই বেছে বেছে বাংলাদেশের জ্ঞানভান্ডারকে আঘাতটা করেছিলো। ‘যুদ্ধ থেমে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু মহাযুদ্ধের অবসান হয়নি কখনো। তারা তো পালাবার সময় জোর গলায় বলেই গিয়েছিল, এই যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ নয়। আমরা ফিরে আসব’। (দুর্যোগের পূর্বাভাষঃ ড. মীজান রহমান)। আজ স্বাধীনতার এত বছর পর যখন দেখি, পাকিস্তানীদের দোসররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে চাপে ফেলে সেই পাকিস্থানীদেরই সাম্প্রদায়িক নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে একে একে। তখন তো বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দেশ আসলে স্বাধীন নয়। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে, কিন্তু পাকিস্তানী চিন্তাধারা থেকে স্বাধীনতা লাভ কি আমাদের হয়েছে ? একটি দেশের মেরুদণ্ড তার শিক্ষাব্যবস্থায়, সেখানে কারো ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ভিত্তিতে শিক্ষা দেওয়া হবে না, শিক্ষকের কোন জাত থাকবে না, পাঠ্যবইয়ে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কারো লেখা অন্তর্ভুক্ত হবে না। সেই আমাদের দেশে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে শিক্ষকদের নাজেহাল হতে হয়। পাঠ্যবই থেকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অঙ্গুলিহেলনে বিলীন হয়ে যায় হিন্দু লেখকদের লেখা, নাস্তিকদের লেখা। যে বিষয় জ্ঞান বিতরণ করবে, সেটাই তো পাঠ্যবইয়ে থাকবে। যে বিষয় মানুষের মনন তৈরি করবে, মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখাবে, তাই তো থাকবে পাঠ্যবইয়ে। কে লিখলো, তার ধর্মীয় পরিচয় কি, সে বিষয়টা কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে সৃজনশীলতার কোন বালাই নেই, মানুষের মনন তৈরীর কোন উৎসাহ নেই, মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের অন্তরায়। তার মাঝে শিক্ষাব্যবস্থাটা এতদিন সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত ছিলো খানিকটা। আজ সেখানে পুরোটাই কালিমা লেপে দিলো। দেশকে দিনকে দিন একটা ভাগাড়ে পরিণত করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবী করা দলটিই। দেশের প্রধানমন্ত্রীই যখন নীরবে সমর্থন দিয়ে যান, একজন গরীব বাউলের গ্রেফতারকে, তখন কার কাছে আমরা আশা করবো ? কি আশা করবো ? আমাদের আশার প্রদীপটি অনেক আগেই নিভে গেছে। তারপরও টিমটিম করে জ্বলছিলো শেষ সলতেটুকু নিয়ে, এই বুঝি সুদিন আসবে। ‘স্বাধীনতা তুমি মহাজনের সিন্দুকে হও গোপন আগুন, কৃষকের পাতে পান্তাভাবে কাঙ্ক্ষিত নুন’ ! স্বাধীনতা তুমি সত্যি কি কাঙ্ক্ষিত নুন হতে পেরেছো ?

কিশোরীর পায়ে স্বাধীনতা কি খুশির মল হতে পেরেছে, নাকি শেকল হয়ে গেছে ? স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি কায়দায় নারীদের অসম্মান চলছে দিনরাত। পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা, যারা ৪ লক্ষ নারীকে অসম্মান করেছিলো। জন্মদিনে বান্ধবীকে গণধর্ষণ করলো এক ছেলে আর তার বন্ধুরা মিলে। তারপর আবার সেটা ফেসবুকে ফলাও করে প্রচার করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে দেখুন, একটা অপরাধ করে আবার দম্ভভরে প্রচার করছে। এটাই কি স্বাধীনতার সুফল ? আবার ওদিকে একজন ফেসবুকে লাইভে এসে প্রচার করেছে, তার অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, কোন এক শশী লজের সামনে অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি দেখে। এবার সেই নারীকে ভার্চুয়াল ধর্ষণ চলছে। কোনদিন হয়তো দেখবো, লেডি জাস্টিসিয়ার মতো সেই মূর্তিটিও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দেশে শিল্প হবে না, শিক্ষা হবে না, স্বাধীনতা থাকবে না কারো।

তারপরও আপনারা যারা বলেন, দেশ উন্নতিতে তরতর করে উঠছে, তাদের এই উন্নয়নের গলাবাজি দেখে আমারও গদগদ হতে ইচ্ছে করে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতির স্বার্থে শরিয়ত বয়াতির উপর অত্যাচার মেনে নিয়ে হবে, নয়তো উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। স্বাধীনতা স্বপক্ষের শক্তির হাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও অধিক সংকীর্ণ হবে, উন্নয়নের রোডম্যাপে এসব পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। স্বাধীন দেশে প্রাণভরে কোন কিশোরী নিশ্বাস নিতে পারবে না, আপনারা বলবেন ‘চুপ থাক', মেয়েদের অত নিশ্বাস নেওয়ারই বা কি আছে। আমাদের পূর্বসুরীরা নিশ্বাস না নিয়েই, ‘আমরা ভীষণ সুখী’ বলে হাসি হাসি মুখে বিদায় নিয়েছে। ওই মেয়ে, তোরা বড্ড লোভী। স্বাধীন দেশে শিল্প বলতে কিছুই থাকবে না, শিল্প হলে অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে।

আমরা সাধারণ মানুষ একটি সাধারণ জীবন চাই। যে জীবনে শোষণ বঞ্চনা থাকবে না। অথচ স্বাধীনতা কি আমাদের তা দিচ্ছে ? ‘যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে, স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি’। আমাদের মহান বীররা সেই প্রিয় জন্মভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, মুক্তচিন্তাশীল বাংলা প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন খুব সহজ, কিন্তু স্বাধীনতার সুফল ঘরে তোলা, ধরে রাখা অত্যধিক কঠিন। আমাদের কথা বলার কোন অধিকার নেই, আমাদের মুক্তভাবে চলাচলের কোন অধিকার নেই, আমাদের নারীরা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছে, আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি এত টুনকো হয়ে পড়েছে যে, আমরা সামান্য শিল্পতেও টলে যাই। তারপরও আমাদের বলতে হবে আমরা স্বাধীন ? কি অদ্ভুত ! একটি দেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করে জনগণের উপর। আমরা সাধারণ জনগণ সবসময় শুধু রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দোষ দেই। এই রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা অন্য গ্রহ থেকে আমাদের দেশে আমদানী হয় নি। আমাদের দেশেই, আমাদের মাঝেই, আমাদের সমাজেই তাদের বৃদ্ধি হয়েছে। রাজনীতিবিদরা বুঝে গেছে, জনগণের পালসটা তারা জানে। তারা জানে কিভাবে এই জনগণকে শোষণ করে তরতর করে নিজেদের উন্নয়ন সাধন করতে হবে। তাই তো সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা ধর্ম বলতেই অজ্ঞান জাতিকে ধর্মীয় বড়ি খাইয়ে উন্নয়ন নামের প্রসব বেদনায় বলছে, সুদিন পয়দা হলো বলে। আমরা নির্ধারণ করে দিচ্ছি, দেশ কাদের হাতে চলবে, কিভাবে চলবে। যে জাতি যেমন সে জাতি তেমন নেতাই পায়। আমরা অত্যধিক মাত্রায় এই ধর্মীয় বড়ি খেয়েছি যে, সে নেশাগ্রস্থদের চেয়েও অধিক নেশাতুর। আমাদের নেশা ভাঙবে কি করে ?

ধর্মীয় গুরুদের আস্ফালনে সরকার পর্যন্ত চুপ, সরকার তাদের পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে ‘জ্বি হজুর, জ্বি হুজুর’ করছে ! সরকার কেন তাদের তোষণ করছে, তাদের ভোটের দরকার বলে ? কই আমরা তো তাও দেখলাম না। শেখ হাসিনা যাদের সমর্থন আর প্রিয়ভাজন হতে চাচ্ছে, কোনদিন পারবে না তাদের প্রিয় হতে। মাঝখান থেকে প্রগতিশীলদের সমর্থন হারাচ্ছেন, যেভাবে একদিন তার পিতা পাশে পাননি কোন ভালো রাজনীতিবিদদের। চাটুকারে পূর্ণ ছিলো তার চারপাশ, তার মৃত্যুতে সেইসব চাটুকার পালিয়েছিলো। 

বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে নারীরা ঘর বন্দি হতে বাকি আছে শুধু। তনু-রুপাদের ধর্ষণ-হত্যার বিচার হয়নি। আমাদের জন্য আর কি বেশি লজ্জার, দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হয়েও নারীরা আজ এত অনিরাপদ সর্বত্র ? আমাদের কিসের উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদের কিসের প্রগতি হচ্ছে ? আমাকে কেউ কি বলতে পারবে, শিল্প নিয়ে এত চুলকানি কেন আমাদের, আমাদের রূচিশীলতা বলে কেন কিছু নেই ? আমাদের তো প্রশ্ন করার অধিকারই নেই ! ভালো মানুষই এ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠবো না তো কি হবো, আমাদের মানবিক হয়ে ওঠার কোন প্রয়োজনই যেন ফুরিয়ে গেছে। শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষা প্রতিটি স্তরে স্তরে আমরা মননহীনতার পরিচয় দিচ্ছি, কুরুচির পরিচয় দিচ্ছি। আমাদের স্বাধীনতা এত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ বোধয় এর আগে কখনো হয় নি। জিতেও আমরা হেরে গেলাম, কূটকৌশলীদের কাছে। তবুও স্বাধীনতার স্বপ্ন অটুট থাকুক, সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় এটুকু প্রতিবাদ করে গেলাম। স্বাধীনতা আসুক আমাদের মননে-চিন্তায়-কর্মে !

সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, বাংলাদেশ