জীবন তৃষ্ণা - যুথিকা বড়ুয়া
এক
কোরোনা মহামারীর কারণে বিগত আড়াই মাস যাবৎ সারা বিশ্বমাবন অতিবাহিত করছে একটানা উচ্ছাসহীন, আনন্দবিহীন, বিষাদ ভরা দিন। অর্থাৎ লকডাউন। বাইরের মুক্ত আকাশের বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগ করা তো দূর, অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ। শুধু তা নয়, দলবদ্ধভাবে গেট টুগেদার হওয়া, সেক্হ্যান্ড করে কুশল বিনিময় করা, একে অপরের সান্নিধ্যে যাওয়া, এ ধরণের শোসালাইজড করা সর্বত্রই অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিজ নিজ সরকার কতৃক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সহসা উচ্ছেদ হবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তুলনামূলকভাবে আমাদের কানাডাতে সম্পূর্ণ লকডাউন না হলেও শোসাল ডিসটেন্স মেনটেন করতে গিয়ে আজ আমরা নিজগৃহেই সবাই বন্দী। অগত্যা, করণীয় কিছু নেই। ফলে ক্রমান্বয়ে গৃহবন্দী থেকে থেকে সংসারের কাজকর্ম যেমন বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে ঘুমের সময় সীমাও অনেক বেড়ে গেছে। প্রাতঃকালে ঊষার প্রথম সূর্য্যের স্নিগ্ধ কোমল আলোর রশ্মি উদ্ভাসিত হোক না হোক সকালে নির্ধারিত সময়ে ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গতে চায় না। আর ভেঙ্গে গেলেও এই শীতপ্রধান দেশে ভোরের দিকে হিমেল ঘরের মতো সারাঘর জুড়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রণে ভরে ওঠে। তখন নরম মোলায়েম আরামদায়ক ব্ল্যাংকয়েটের উষ্ণ অনুভূতিকে সজোড়ে আলিঙ্গন করে কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রাদেবীর বাহুমন্ডলে গভীরভাবে অচৈতন্যে আবার বেহুঁশ হয়ে পড়ি। এমন সময় একদিন হঠাৎ খটখট শব্দে নড়ে ওঠে দরজার কড়া। আমি তন্দ্রাজড়ানো চোখে ধড়ফড় করে উঠি। মুহূর্তের জন্য স্বপ্ন না বাস্তব, ঠাহরই করতে পারছিলাম না। ঘুমে এতোটাই আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, চোখ মেলে তাকাতেই পারছি না। জানালার দিকে চেয়ে দেখি, সুস্পষ্টভাবে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। মনে হোলো, তখনও আবছা অন্ধকার বাইরে। কূয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক। গভীর নীরব, গাঢ় নিস্তদ্ধ। রাজ্যের পশু-পক্ষীরাও সব নিদ্রায় মগ্ন। ঘড়ির কাঁটা চলছে হৃদস্পন্দনের মতো টিক্ টিক্ শব্দে। যেন এক রহস্যাবৃত অতন্দ্র মায়াবী রাত। মনে হচ্ছিল, চন্দন পালঙ্কে শুয়ে যেন স্বর্গেই ভাসছি।
ইতিপূর্বে আবার নড়ে ওঠে দরজার কড়া। উৎকণ্ঠায় শুনলাম কান পেতে। নাঃ সত্যিই কে যেন দরজা নক্ করছে। ভাবলাম, গোয়ালা এসেছে দুধ দিতে। কিন্তু রাত না পোহাতেই!
বিব্রোত কন্ঠে বললাম,- ‘কিরে মদন, ঘুম নেই তোর! ভোর না হতেই দুধ নিয়ে এসেছিস। দিলি তো ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে!’
কিন্তু কোথায় মদন! কারো কোনো সাড়া-শব্দ নেই। অথচ ক্ষণপূর্বেও দরজার খট্খট্ শব্দে কানে একেবারে তালা লেগে যাচ্ছিল। হঠাৎ পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে চমকে উঠি ঘড়ি দেখে,-এ কি, মাত্র পৌনে চারটা বাজে। এই অসময়ে, ভোর রাত্রে কে এলো! কোনো অঘটন ঘটলো না তো কারো!
এইভেবে বিছানা ছেড়ে দ্রুত নেমে আসতেই চুড়ির ঠুন্ঠুন্ শব্দ শুনে আমি কেঁপে উঠি। একেই কাঁচা ঘুম থেকে উঠেছি। নাক কান সব বন্ধ হয়ে আছে। গলা দিয়ে স্বরই বের হচ্ছে না। কিন্তু দরজার ওপ্রান্তে কার যে আর্বিভাব, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। দুইহাতে চোখ ডলতে ডলতে নেমে আসি বিছানা ছেড়ে। শিথিল ভঙ্গিতে দরজার কাছে গিয়ে ফ্যাস্ ফ্যাস্ শব্দে বললাম,- ‘কে ওখানে?’
বলে দরজাটা দ্রুত খুলতে যেতেই দরজার ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠস্বর। আমি থমকে দাঁড়াই। সে একেবারে আহাল্লাদে ফেটে পড়ছে। সহাস্যে বলছে,- ‘এ্যাই, আমি রে আমি, শ্রাবণী, শীগ্গীর দরজা খোল! দ্যাখ্, কে এসেছে!’
মহিলার নাম শুনে মুহূর্তে ঘুমের নেশা গেল উধাও হয়ে। পড়ে গেলাম বিস্ময়ের ঘোরে। শ্রাবণী, নামটা তো খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আমতা আমতা করে বললাম, -‘তা এই অসময়ে! কে এসেছে সঙ্গে?’
বিব্রোত কন্ঠে শ্রাবণী বলল,- ‘দরজাটা আগে খোল তো! ভীষণ ঠান্ডা লাগছে বাইরে।’
-‘না খুলবো না। আগে বল, সঙ্গে কাকে নিয়ে এসেছিস!’
-‘এই ন্যাকামি করিস না তো! তুই জানিস না কে!’ সহাস্যে বলল,- ‘দ্বীপকে নিয়ে এসেছি সঙ্গে। আমার সন্দীপ। ও’ আমার, আমারই থাকবে। কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবো না। কেউ পারবে না আমার হৃদয় থেকে ও’কে ছিনিয়ে নিতে। কোনদিনও না।’
হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, খুব দশ্যি মেয়ে ছিল শ্রাবণী। কাউকে গ্রাহ্য করতো না। খই ফোটার মতো চোখেমুখে এক নিঃশ্বাসে কথা বলতো। যেমন ছিল একরোখা, অনমণীয় জেদী, তেমনি বজ্জাত, বেপরোয়া মনোভাব। ওর কোনো জিনিস কেউ ছুঁতে পারতো না। সেই শ্রাবণী! কিন্তু তা-ইবা কেমন করে সম্ভব! বহুকাল আগে সন্দীপ বিয়ে করে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম। ওর নাগাল পেল কেমন করে! আশ্চর্য্য, কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা!
সবুর সয়না শ্রাবণীর। ক্ষণিকের নীরবতায় অস্থির হয়ে ওঠে। বিরক্তি প্রকাশ করে দরজায় জোড়ে ধাক্কা দিতে থাকে। -‘ওঃ হোঃ, বলছি না দরজাটা খুলতে!’ বলে পরক্ষণেই খিলখিল্ করে হেসে ওঠে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বিস্ময়ে। রুদ্ধ হয়ে গেল আমার কণ্ঠস্বর। আমি অভিভূতের মতো হাঁ করে থাকি। বিশ্বাসই করতে পারছি না নিজের কানদু’টোকে। ফূর্তিতে মন-প্রাণ একেবারে টববগ করছে শ্রাবণীর। খুশীর প্লাবনে হৃদয়ের দুকুল যেন ওর ভেসে যাচ্ছে। বলে কি শ্রাবণী! আর কেনইবা আজ এতকাল পর সন্দীপকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই চকিতে একটুকরো বেদনাময় স্মৃতির তীব্র জাগরণে মনটা আমার উদাস হয়ে গেল। গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে গেলাম কল্পনার সাগরে। ধীরে ধীরে মনঃশ্চক্ষে উদ্ভাসিত হতে লাগল, পাথরের মূর্তির মতো বোধশক্তিহীণ অচৈতন্য শ্রাবণীর মূর্ছে যাওয়া সেই বিরহকাতর মুখখানা।
(দুই)
শ্রাবণী অসাধারণ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা। তিখালো নাসিকা। লম্বা ঘনকালো কোঁকড়ানো রেশমী চুল। কপালের ডান দিকে সবসময় ঝুলে থাকতো একগোছা চুল। হরিণের মতো টানাটানা চোখ। মায়াবী চাহনি। ঠোঁটের বাঁদিকে বড় কালো একটা তিল। শ্বেতাঙ্গদের মতো দুধসাদা গায়ের রঙ। কি মসৃণ, স্নিগ্ধ কোমল মুখমন্ডল। যাকে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে নজর ফেরায়, সাধ্য কার! বিধাতা যেন তাঁর অকৃপণ নিপুণতা ঢেলে ওকে গড়ে ছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান প্রতিটি মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো ওর উপছে পড়া সুকোমল যৌবন। যেমন প্রজাপতির মতো প্রাণবন্ত চঞ্চল তেমনি ওর ঠোঁটের কোণে তরতাজা হাসির একটা রেখা সর্বদা লেগে থাকতো। এমনিই হাসির একটা ছোঁয়াচে রোগ ছিল। কাউকে হাসতে দেখলে কি রগড়টাই না করতো। নিজেও হাসতো আর পাঁচজনকেও হাসাতো। কিন্তু ওর এই বেলেল্লাপণা একদম পছন্দ করতেন না ওর মাতা রানী রেনুবালা। তিনি ছিলেন সেকেলে মহিলা। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। ওনার উঠতে বসতে আপত্তি, অভিযোগ। মন্ত্রের মতো সারাদিন গজ্গজ্ করতেন। অথচ কৈশোরের দৌড়-ঝাঁপ পেরিয়ে যৌবনের চৌকাঠে পৌঁছেই সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল শ্রাবণী। কিন্তু ওর মন পাখীটা কখন যে পাড়ার নবাগত হ্যান্ড্সাম সন্দীপের হৃদয়দ্বারে উড়ে গিয়ে বসেছিল, তা নিজেও টের পায় নি শ্রাবণী।
সেবার কাল-বৈশাখীর প্রচন্ড ঝড়-তুফানে পাড়ার মুখুজ্জ্যে জ্যোঠার বিস্তর প্রান্তর জুড়ে আমবাগানের গাছের কাঁচা-পাকা আমগুলি সব ঝোরে গিয়েছিল। আর ঝড় থামতেই পাড়ার শিশু-কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী সবাই ছুটে গিয়েছিল আম কুড়োতে। ছুটে গিয়েছিল শ্রাবণীও। যেদিন উজ্জ্বল সুঠাম সুদর্শণ তরুণ যুবক সন্দীপের পুরুষোচিত চেহারা এবং মিশ্রব্যক্তিত্বের এক মুগ্ধ আকর্ষণে শ্রাবণীকে বেশ কিছুক্ষণ বুদ করে রেখেছিল। যেদিন আকস্মিক প্রেমের পত্তন ঘটে ওর হৃদয়পটভূমিতে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ভালোবাসার বীজ রোপন করতে ওকে প্রচন্ড উদ্বুদ্ধ করেছিল, উৎসুক্য করে তুলেছিল। যেদিন মনমন্দিরে প্রথম স্থাপণ করেছিল, ওর জীবন দেবতার রাজ সিংহাসন, দেবতার আসন। যার আধিপত্য ছিল শুধুমাত্র সন্দীপের। যা কেউই জানতো না। প্রতিদিন কলেজ শেষে ফিরতি পথে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রেল ষ্টেশনের সংলগ্ন প্রকান্ড কদমগাছের নীচে তীর্থের কাকের মতো সন্দীপের অপেক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতো। অথচ একবারও ভেবে দ্যাখেনি, সন্দীপের হৃদয়ের গভীরে কখনো পৌঁছাতে পারবে কি না। কখনো ওর নাগাল পাবে কি না। ওর মনের ইচ্ছাটা কখনো প্রকাশ করতে পারবে কি না। কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সন্দীপের মনের ঠিকানা খুঁজে না পেলেও শ্রাবণীর চোখের ভাষায় সন্দীপ ঠিক বুঝে নেবে, ওর কোমল হৃদয়ের উষ্ণ অনুভূতির কথা, ওর মনের কথা। কখনো না কখনো সন্দীপ ওর প্রতি একদিন আকৃষ্ট হবেই! ওর প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়বেই! শ্রাবণী কোনদিন হার মানেনি, আজও মানবে না। হার মানতে শেখেনি শ্রাবণী।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রাবণী। সুরের মূর্ছণায় গুনগুন করে গান গাইছিল। হঠাৎ নজরে পড়ে, পাড়ার চৌরাস্তার মোড়ে একা দাঁড়িয়ে সন্দীপ। ওর আশে-পাশে কেউ নেই। কিন্তু কারণ না জেনেই মনটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অনাবিল খুশীতে ভরে ওঠে। মনে মনে বলে,- ‘আজ আর কিছুতেই ছাড়ছি না, এই সুবর্ণ সুযোগ। বাবু না কি মেয়েদের দিকে তাকায় না। কখনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যায় না। হুঁঃ সাধু পুরুষ। দাঁড়াও, কেমন করে বশ করতে হয়, তোমায় দেখাচ্ছি।
এইভেবে শ্রাবণী উর্দ্ধঃশ্বাসে দৌড়ে নেমে আসে নিচে। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ততক্ষনে একটা জিপগাড়ি এসে দাঁড়ালে সন্দীপ অবিলম্বে লাগেজ তুলতে থাকে গাড়ির ট্রাঙ্কে। তা দেখে বুকটা ওর ছ্যাঁৎ্ করে ওঠে। হ্দ্স্পৃন্দন আরো দ্রুতগতীতে চলতে থাকে। চাপা আর্তনাদে শ্রাবণী স্বগতোক্তি করে ওঠে,-‘এ কি, এত বড় বড় লাগেজ নিয়ে সন্দীপ যাচ্ছে কোথায়? দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে না কি! কিন্তু কেন?’
সন্দীপ জিপগাড়িতে উঠে বসে পড়তেই ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে সন্দীপের বক্ষপৃষ্ঠে ঝাপিয়ে পড়তে। ওর পেশীবহুল বাহুদ্বয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে একেবারে পিষ্ঠ হয়ে যেতে। ওর হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসার আবগাহনে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে। ওর পুরুষালী দেহের উষ্ণ অনুভূতিতে বুদ হয়ে থাকতে। ইচ্ছে হচ্ছিল সন্দীপকে বাঁধা দিতে, কৈফেয়ৎ চাইতে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কবে ফিরবে? কিন্তু সেই কৈফেয়ৎ শ্রাবণী চাইবে কেমন করে? কোন্ অধিকারে? কোন্ সূত্রে? ও’ হয় কে সন্দীপের! সম্পর্ক তো দূর, আলাপ-পরিচয়ই এখনো হয়নি! তা’হলে?
শ্রাবণী নীরব, নির্বিকার। পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর সম্মুখেই চলে গেল সন্দীপ। পারেনি ওকে বাঁধা দিতে। ওর পথ অবরোধ করতে, নির্লজ্জের মতো নিজেকে স্বেচ্ছায় ধরা দিতে। পারেনি, ভালোবাসা নামে চির সত্য ও পবিত্র এবং শ্রুতিমধুর শব্দটি মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে। মেঘের আড়ালে সূর্য্য ডুবে যাবার মতো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল সন্দীপ। নিমেষে চলমান গাড়ির ভীঁড়ে মিলিয়ে গেল। তখন থেকেই মনকে প্রচন্ড আন্দোলিত করে। অনুতাপ অনুশোচনায় হৃদয়াকাশের বুক চিরে বারবার বেদনার ঝিলিক দিতে থাকে, কেন পারলো না ছলা-কলা-কৌশলে সন্দীপকে প্রেমের ডোরে বাঁধতে। ওর মনের কথাটা জানাতে। নির্জন নিরিবিলিতে একটিবার কেন মুখোমুখি ওর সাথে দেখা হোলো না!
চাপা আর্তনাদে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে শ্রাবণীর। ওর ঠোঁট কাঁপে, বুক কাঁপে, কাঁপে সারাশরীর। অশ্রæসিক্ত চোখে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। অনুভূব করে পায়ের তলা থেকে মাটিটা যেন সড়ে গেল। সন্দীপকে না পাবার চরম ব্যর্থতায় বুকের কষ্টগুলি একসময় তরল হয়ে দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। পারেনি সম্বরণ করতে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যেদিন গহীন অনুভূতি দিয়ে জীবনে প্রথম অনুভব করেছিল, নিজের ভিতরে যে তীব্র অনুভূতির জাগরণ, তাতে শিহরিত হয় ওর সারাশরীর। শ্রাবণী নিজেই টের পায় তা সম্পূর্ণ এক নতুন বিস্ময়। এক অভিনব অনুভূতি। সন্দীপকে সত্যিই মনে-প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে। সন্দীপই ওর জীবনের সব। ওর হৃদয় নামক বিশাল সাম্রাজ্যের সন্দীপই একমাত্র সাম্রাজ্ঞী।
শুধুমাত্র সুদর্শণই নয়, সন্দীপ একজন আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মার্জিত পুরুষ। উচ্চবিত্ত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। শ্রাবণীর মুখপানে কখনো চোখ তুলে চেয়ে দ্যাখেনি। অথচ দৃঢ় মনের অধিকারী এবং উচ্চাভিলাষী শ্রাবণীর মন যখন যা চাইতো তা-ই হাসিল করে নিতো। সন্দীপই ওর একমাত্র উপযুক্ত পাত্র।
তারপরেও নিরাস হয় না শ্রাবণী। অপেক্ষা করে থাকে, ভালোবাসার যে ফুল মনের অজান্তে ফুটে গিয়ে ছিল, তারই সুমধুর সুরভী ঢেলে ওর স্বপ্নের রাজকুমার সন্দীপকে মোহিত করবে। প্রেমে আপ্লুত করবে। ওকে একান্ত আপন করে প্রাণের ডোরে বেঁধে নেবে। স্থাপন করবে হৃদয়ের রাজসিংহাসনে, দেবতার আসনে।
কিন্তু বিধি বাম, শ্রাবণীর স্বপ্নের রাজকুমার সন্দীপ আর দেশে ফিরে আসেনি। রসায়ন বিজ্ঞানে ডক্টরেট করতে গিয়ে পৈত্রিক বিষয়-সম্পত্তি উপেক্ষা করে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির হাজার বৈষম্য লঙ্ঘন করে, বাঙালির ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়ে জীবনসঙ্গিনী রূপে বেছে নেয়, ইংলেন্ডের এক শ্বেতাঙ্গপরীকে। সেখানেই স্থায়ীভাবে গড়ে তোলে ওর ভালোবাসার রাজপ্রসাদ। যার কোনো পিছু টানই ছিলনা।
শুনে মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে শ্রাবণীর। নিভে গেল ওর আশার প্রদীপ। মরে গেল বেঁচে থাকার সাধ, ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি। শুকিয়ে গেল ওর একান্ত ভালোবাসার ফুল। সবই অনর্থক, প্রয়োজনহীন, অবাঞ্ছিত মনে হতে লাগলো। জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত কামনা-বাসনার গলা টিপে তরতাজা ফুলের মতো জীবনটাকে অর্থহীন করে তোলে। যেখানে আনন্দ নেই। চাহিদা নেই। উদ্যাম নেই। নেই নতুন কোনো স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা।
শ্রাবণী পারেনি মেনে নিতে। পারেনি, পরাজয়ের গ্লানি নির্বিকারে সহে যেতে। সন্দীপকে না পাওয়ার ব্যর্থতায় অচীরেই পৃথিবীর সমগ্র মায়া-মোহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেছে নেয় নির্বাসিত জীবন। শরীরের প্রতি অত্যাচার আর অবহেলায় আহত পাখীর মতো পড়ে থাকে বদ্ধঘরের কোণে।
হঠাৎ অনুভব করি, বিশ্বব্রম্ভান্ড জুড়ে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। এলোপাথাড়ী ঝোড়ো হাওয়া বইছে। দুলছে গাছের লতাপাতা। কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে গোটা আকাশ। শুরু হয় গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন। হৃদয় কাঁপানো বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক।
ক্রমাণ্বয়ে মেঘের গর্জন আর প্রবল শীততাপের তীব্র অনুভূতিতে ঘুমটা আমার তখনিই সত্যি সত্যিই ভেঙ্গে গেল। আমি ধড়ফড় করে উঠি। তাকাই চারিদিকে। স্বপ্ন না বাস্তব, কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। বয়ে যায় সময়। ঘুমের নেশা কেটে যেতেই চোখ পাকিয়ে দেখি, কেমন বিষাদভরা সকাল। সূর্য্যরে আলো নেই, পাখীর কলোরব নেই। ঝুপঝুপ করে অঝোরে ঝড়ছে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। কিছু দেখা যাচ্ছে না বাহিরে। কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা কুঁকড়ে আমি শুয়ে আছি বিছানায়।
ইতিমধ্যে ঢং ঢং শব্দে ঘড়ির ঘন্টা বেজে উঠতেই বোধগম্য হয়, সকাল হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বেলা দশটা বাজে। কোথোয় শ্রাবণী? তবে কি এতক্ষণ সব স্বপ্ন দেখছিলাম আমি!
যুথিকা বড়ুয়া। কানাডা
লেখিকা, কানাডার টরোন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
[email protected]
-
গল্প//উপন্যাস
-
27-05-2020
-
-