বাঁচতে ঠিক কত আগুন লাগে!! -পারমিতা ভট্টাচার্য
সেদিন শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল পৃথিবী......
সূতিকাগার থেকে ভেসে আসছে
অনাহুত অতিথির আগমন বার্তা
দাই মা এর খবর শুনে শূন্যে ঘুরপাক খেয়েছিল চিল
"মেয়ে হয়েছে গো......."
ঠাকুমা তুলসিকাঠির মালা জপতে জপতে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল
"শাঁখ বাজাতে হবেনা আর, সবই কপাল আমার..."
উঠোনে দাঁড়িয়ে পিসি, আমার দিদিকে বলেছিল "পোড়ামুখী, অলুক্ষণে, এবারেও একটা ভাই আনতে পারলনা গা!!...."
"শুধু মা ক্লান্ত শরীর টেনে আমায় বুকে নিয়ে
অলক্ষ্যে চোখের জল মুছেছিলো জীর্ণ কাপড়ের খুঁটে,"
"অবাঞ্চিত জন্মকুন্ডলি লিখেছিল ভগবান আমার কপাল জুড়ে
আমিও তখন থেকেই মনে মনে নিজেকে যেন এই সংসারের বাড়তি বোঝা ভেবেছিলাম,"
"শুধু বাবা শিখিয়েছিল, মনে মনে আগুন জমিয়ে রাখতে......."
মেয়েটি বুকে চুপিচুপি ঘূর্ণি জমিয়ে রাখতো
কেউ জানেনা সে কথা
নদীর ধারে গেলে শুধু নদীর জল
ফিসফিস করে তার কানে বলতো
"আগুন জমাও, আগুন
বুকের খাতে গড়িয়ে দাও লাভাস্রোত;"
মেয়েটি বসন্তে কৃষ্ণচূড়ার আগুনে পুড়তে পুড়তে
শীতে মিঠে রোদে পুড়তে পুড়তে
শরতে দেবীর বোধন হলে
নতুন জামার কোঁচড়ে আগুন জমিয়ে রাখতো
মেয়েটির জন্মের পরেই তার বাবা
একটা মেহগিনী গাছ বসিয়েছিল....
সংসারে ব্রাত্য মেয়েটি খুব কষ্ট হলে সেই গাছটার বুকে মাথা দিয়ে দাঁড়াতো
আর পাঠ্যবইয়ের নারী জাতির সংগ্রামের ইতিহাস ছড়িয়ে দিত তার শিকড়ের প্রতিটি রন্ধ্রে
বাবার গায়ের গন্ধ ছিল মেহগিনীর বাকল ছুঁয়ে
গাছটি ফিসফিসিয়ে তার কানে শব্দ ঢেলে দিত
"আগুন জমাও আগুন, বাঁচতে গেলে পাঁজরে হাপর টেনে আঙরা জিইয়ে রাখতে হয়...."
সংসারে আজ সারা শরীর জুড়ে নীল মৃত্যু নাচে
কেরোসিন, দেশলাই আর ছিনাল শোকের বার্তায়
ভারী হয়ে ওঠে প্রিয়জনের কুমিরাশ্রু
মেয়েটি তার অসাড় ঠোঁট দুটি নেড়ে পৃথিবীকে বলে
"তবুও আমি মাফ করে দিই সবার অপরাধ"
হসপিটালের বেডে জ্বালায় ছটফট করা সেই মেয়েটির অর্ধচেতন কানে নার্স এসে বলে
"আগুন জমাও মনে, শক্তি জমাও, এই লড়াই তোমায় জিততেই হবে...."
মেয়েটি আয়নায় মুখ দেখেনি আর....
কারণ দেখার কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা তার
তবু সেও বাবার মতোই একটা মেহগনি পুঁতেছিলো জঠরের অন্ধকারে....
যত্ন করে তার সবটুকু আগুন ঢেলে দিয়েছিল গাছটির শরীরে
বুকের বামপাশে শীতলপাটি বিছিয়ে আয়েস করে বসে
দুপাশে চুলের বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে তার মেহগিনীর কচিপাতাকে বলতো
"আগুনকে বশ মানাতে পারবি তো??
আগুন তোকে জ্বালাতেই হবে,
বইয়ের পাতায়, খাতার পাতায়, পারবি তো??"
"বাবা আমি তোমার কথা রাখতে পেরেছি বাবা,
আমি আজ আগুনের মা হতে পেরেছি
আমি বুকে আগুন পুষতে পেরেছি ....."
আজ মেয়েটি আবার গ্রীষ্মের সেই ক্ষীণস্রোতার ধারে এসে বসে.. ..
শুধু তার চোখেই চোখ রেখে সে বলতে পারে
"আগ্নেয়গিরি হয়ে বাঁচতে চাইনি তো কখনও
একটা মেয়ের জীবনে
বাঁচতে গেলে ঠিক কত আগুন লাগে??"
কাঁধে হাত রেখে একটা মায়ের আগুনে- মেহগিনী বলে
"তার হিসেবে হয়তো চিতার কাঠও পর্দানসিন হয়
প্রাচীন বর্বরতায়...
তবু বাঁচতে গেলে, আগুন জ্বালানোর অভ্যাস জারি রাখতেই হয়...."
পারমিতা ভট্টাচার্য। হুগলী
-
ছড়া ও কবিতা
-
21-08-2020
-
-