আমি ও সে - পুলক বড়ুয়া
মধ্যাহ্ন৷
একটি দুপুর এবং তার পথ-ঘাট বৃষ্টি ভেজা৷
বোঝাই যায়, বয়সে আমার চেয়ে একটু বড় আর লম্বাও৷ দেখতে মানুষকে যেমন দেখায় আর কি৷ এক পলকে এই তো, এর চেয়ে বেশী কিছু তো নয়৷ বেশী কিছু মানুষের চোখে পড়েও না৷ এত কিছু মনে হয়ও না৷ যা ঘটেছে, এমনটি হতেও পারে! অস্বাভাবিক নয়৷ সে সে কী শুধু আটকাতে গেল— পড়ে যাওয়া থেকে ঠেকাতে? বৃষ্টির পানিতে ভেজা কিঞ্চিত ঢালু থেকে বাঁচাতে! নাকি নিজেই নিজেকে বেশী ভালো বানাতে গিয়ে নিজের গলা টিপে— অশালীন আর স্রেফ অশ্লীল অভিজ্ঞতার স্বরচিত অভিধার আত্মিক বন্ধনী থেকে রেহাই পেতে অথবা বিপরীত দিক থেকে আমার ভেতরে যেন অসভ্যতা-অপবাদের মিথ্যে তীর উদ্যত হয়ে না-ওঠে, তার জন্যে নিজেকে আড়াল করতে— অগত্যা এ স্বয়ংক্রিয় ভূমিকা তার? হায়, নির্মম নিরাপদ বাঁচোয়া! তার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে— আমাকে সামলাতে, নিজেকে সামলাতে?
না-হয় আমি পিছলে পড়ে যেতাম? না-হয় আমি ওর বুকের উপর আছড়ে পড়তাম! তাতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? তাতে কার কী৷ তাতে কার ক্ষতি হতো? প্রকাশ্য দিবালোকে ও এভাবে ঠেকিয়ে দিল কেন৷ এ কি কৃতিত্ব দেখাবার জন্যে; মানুষকে দেখাবার জন্যে৷ যতসব লোক দেখানো, ভন্ডামী৷ আসলে ও একটা ঠগবাজ, লোক ঠকানো লোক৷ এটা ওর আসল রূপ নয়, মুখোশ৷ মুখ দেখে যা সহজে যায় না চেনা৷ মুখই তো দেখলাম না– কেউ কারও৷ ও এত দ্রুত চলে গেল, আমিও৷ ঘটনার আকস্মিকতায়— হয়তবা উভয়ে অপ্রস্তুত হয়ে৷ জোরপূর্বক অস্বাভাবিক স্বভাবিকতায়৷ এমনটা তো যে কারও হতেই পারে৷ এজন্যে তো কেউ কাউকে দায়ী করতে পারি না, কেউ কারও কাছে দায়ী নই৷ বরং ও যাচ্ছিল, আমার তীব্র গতি— ওর সঙ্গে ধাক্কা লাগবেই, কিছুটা পরশ লাগতেই ও আমার বাহুমূলে হাত দিয়ে ঠেকালো৷
না-হয় আমার উন্নত বুক জোড়া, যুগল বক্ষ ওর বাহুতে মৃদু চাপ খেত৷ একটু ধাক্কা৷ এতে আমার দৃঢ় বুক দুটি এতটুকু ব্যথা পেত? সে তো পেতই না৷ নাকি আমরা আরাম পেতাম! একটা অযাচিত, অভাবিত ভালোলাগা বোধ হত? একটা অপ্রত্যাশিত সুখবোধ হত? যার ছোঁয়াটুকু ও অস্পষ্ট বুঝতে পারবে কী পারবে না— এরকম এক কুয়াশাময় অনুভূতিটুকু ও এখন অনুভব করতে পারে শুধু৷ যাইহোক, এই অঘটনঘটনপটিয়সী— এর জন্যে দায়ী- আমি নই৷ এতে আমার হাত নেই, ওর হাত ছিল৷ যাইহোক, মেঘ না-চাইতে জলের মতো— ও একটা নিশ্চিত উপহার থেকে বঞ্চিত হল৷ আসলে ও একটা ভীতুর ডিম৷ ও নিতেও জানেনা, দিতেও জানে না৷ ওরা বা এরা নিজেকে ঠকায়, অন্যকেও৷ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে জানে না৷ সুযোগকে গ্রহণ করতে পারে না৷ জয় করতে করতেও জয়ী হলো না কোনো কালে৷
আসলে আমি কতোটা জানি, ওর অতীত-বর্তমান৷ শুধু তো মাত্র ক`টি মুহূর্ত৷ আমি নিপুণ জ্যোতিষীর মত ওর ভূত-ভবিষ্যত বলে দিতে পারি? আমি তো এতটা প্রাজ্ঞ নই৷ না, সাধ্য আছে আমার৷ কিন্তু ও আমাকে বাধা দেবার কে? আমার স্বাধীন গতিকে রুখে দেবার কে? আমার শরীরের এক অনির্বচনীয় পুলক, আস্বাদ নষ্ট করবার কে? আমার শরীরের উপর হস্তক্ষেপ করলো কেন? হয়তো এ মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত জীবনবোধ, সংগুপ্ত বিচিত্র তাড়না-দায়বোধের ওপরই বর্তায়৷ যা বলে-কয়ে দিতে হয় না৷
তাই বলে সকল সময় সঙ্গত নয়, স্বচ্ছন্দ মনে হয় না৷ একেবারে জবুথবু কুঁকড়ে যাওয়ার কি আছে৷ আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার মত আঁৎকে উঠতে হবে নাকি৷
না, না এ কোনো ভদ্রতাও নয়, জাস্ট দেখানোপনা৷ যা আমি মাইন্ড করেছি৷ এরকম পুরুষেরা ঠিক স্বাভাবিক নয়৷ কাপুরুষ৷ এরা আমার দুচক্ষের বিষ৷ মানুষ নয়৷ মেয়েদের চেয়েও খারাপ৷ ওকে আমার স্বপ্নের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে, কল্পনার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে যা-ইচ্ছা তুলোধুনো করে ছাড়বো৷
আমি তো দেখতে আহামরি সুন্দরী না-হলেও— কুরূপা নই, খাটো বা লম্বা না-হলেও প্রমাণ সাইজ, — কালো, অস্তিচর্মসার নই৷ আর তিনিও এমন কোনো সুঠাম মনে হয় নি যে, আমাকে নিমেষে অমন অবজ্ঞা করতে পারেন!
না, আমি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না৷
না, আমি ওকে ক্ষমা করবো না৷ আমি এটা কিছুতে ভুলতে পারবো না৷ ও কি ভাবছে-না-ভাবছে তা তো আমি জানি না৷ কিন্তু ও আমাকে এরকমটি ভাবতে বাধ্য করেছে৷ ঘটনাটি তো সেই জন্ম দিয়েছে এবং ভেতরে দায়ভার শুধু আমার একার হলে— আমার একার প্রতি অবিচার করা হয় না কী?
সে আমাকে খাটো করেছে, ছোট লোক৷ আমার কী অহংকার করার মত কিছু নেই; সে একাই নিয়ে যাবে; মনে মনে অহংকার করবে: কাউকে অপমান করে! এটা ভাবলে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না, মানতে পারি না৷
আসলে, ও একটা নপুংসক! নপুংসকেরা চিরকালই গুটিয়ে বেড়ায়৷ জড়সড় হয়ে থাকে৷ ওরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারে না৷ ওরা অক্ষম, ব্যর্থ৷ নিজেদের পরাজয় স্বীকার করতে চায় না৷ অথচ, ওরা জানে না ওরা পরাজিত৷ পরাজয়কে কে না ভয় পায়? ভাবে, ধ্বংস হয়ে গেলাম! পরাজয়ের চেয়ে লড়াই করে ধ্বংস হয়ে যাওয়াতেই শ্রেয়বোধ৷ বীরত্ব৷ মর্যাদা৷ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সেরা পরিচয়৷ এর বিপরীত বলয়ের মানুষেরা কলঙ্কের চাদর মুড়ি দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়৷
ও এমন করে চলে গেলো কেন? একটু দাঁড়িয়ে ভদ্রতা দ্যাখাতে পারতো, স্যরি বলে৷ তারপর না হয়, নাক সিধা যাক না৷ নিজেকে কী নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য এত ডাঁটো হতে হয় নাকি? নেই মামার চে‘ কানা মামা ভালো গোছের মানুষ? হতে পারে, অল্পেই তুষ্ট; এত অল্পেই? যৎসামান্যেই খুশী! পুরুষের ভন্ডামীতে তো রাখঢাক নেই, সরাসরি ধরা পড়ে যায়৷ ভ্রমরের মতো ওরা বেশ্যার বাড়ি যায়, পরকীয়ায় জড়ায়৷ দেহজ কসুমের ঘ্রাণ, ফুলে ফুলে ঢলে পড়ে মধু খেতে চায়৷ লক্ষ্য একটাই, নিশানা একদম ঠিক৷
ও কে আমি কতোটা চিনি? ব্যতিক্রমও তো হতে পারে৷ আচ্ছা, ভদ্রতা করেও তো আরও ব্যতিক্রমী হওয়ার বহু দিক আছে, অনেক সুযোগ আছে৷ অমন ভীড়ের মধ্যে আঁকা-বাঁকা, সর্পিল ভেঙে-চুরে যেতে হয়? ন্যাকামো! আদিখ্যেতা দেখে বাঁচিনে!
আচ্ছা, আমি এমন করে ভাবছি কেন৷ হয়তো ও এত মনোযোগী ছিল না, বিক্ষিপ্ত ছিল মন, এতোটা খেয়াল করে নি, ভাববার কোনো ফুরসৎ পায় নি— জরুরী কোনো কাজে ছুটছিল! তাই বলে কী পরেও আমার কথা মনে হয় নি— এ ঘটনার কথা মনে পড়ে নি৷ ভাবনার উদ্রেক করে নি৷ একটুও-না! না, একটু-আধটু? এখন বিস্মৃত হয়ে গ্যাছে৷ আমি ওর কাছে শেষ৷ আর মনেই রাখে নি৷ আমি আর মনেই পড়ি না৷
ধ্যুত্তুরি ছাই৷ কোথায় কে, চিনি নি, জানি নি, শুনি নি, দেখি নি৷ তাকে নিয়ে৷ এতসব৷ যতসব৷ পাগলামো৷ আমার৷ এছাড়া৷ লোকে, বলবে কী? এইসব অভিধা দেওয়া ছাড়া!
আচ্ছা, এমন যদি হয়, ফেসবুকে দিলাম৷ ওর নজরে পড়বে কী? খুঁজে পাবো কী? অনেকেই তো মিথ্যে গল্প ফেঁদে বসতে পারে? আমি নিশ্চিত হবো কী করে— সত্য-মিথ্যা? উল্টো, — বহুজন জেনে যাবে৷ আমার বুকের ভেতরের চুপ-কথা৷ গোপন গল্পটা তাই বিজ্ঞাপন হয়ে উঠুক, আমি চাই না৷ সস্তা, হাল্কা, চটুল কোনো উপায় আমার কাম্য নয়৷
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, অকুন্ঠিত নয়, কুন্ঠিত হয়েই চলে গ্যাছে৷ প্রত্যাশার মধ্যেই ভর করেছিল প্রত্যাখানের ভয়৷
অথবা, অমর হতে চেয়েছিল আমার ভেতর এভাবে এই বদান্যতায়৷ ভ্রুক্ষেপহীনতার বদৌলতে৷ এক আপাত অমানবিক তীব্র প্রচ্ছন্ন আশ্চর্য আঘাতে৷ এও তো এক দূরপাল্লার— ঘায়েল করার— কৌশলী-মানবিক অস্ত্র প্রয়োগ৷
কিন্তু সে কি আততায়ী থেকে যাবে৷
আবার, এও তো হতে পারে, সে আমাকে পাত্তাই দেয় নি, পছন্দই করে নি৷ অথবা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সলজ্জ৷ সবচেয়ে ভাল হত, এই প্রহরটা মাথার ওপরে রামধনুকের মত আলো ছড়ালে৷ নীরবে, নিভৃতে জেগে থাকলে৷ মুখোমুখি চেয়ে থাকলে৷ মুখর হলে৷ কথা হলে৷ পারস্পরিক আলাপচারিতা৷ সাক্ষাৎকার৷ এতে পরস্পরের প্রতি আগ্রহ-আকর্ষণ সন্তোষজনক বা অসন্তোষজনক একটা মাত্রা পেত৷ তাৎক্ষণিক, সুন্দর বা অসুন্দর যাই হোক৷ প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত৷ আশু৷ সম্মানজনক৷ এমন অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট রেখায় চলে যেত না৷ এরকম অতৃপ্তি, এতটা ভোগান্তি আমার হতো না৷
কেন যে সহজে সহসা অন্যরকম আত্মপ্রকাশ আমাদের ঘটে না!
তবে কি, কথা হলেই কী এইসব কথা হারিয়ে যেত! আমি কিংবা সে অথবা উভয়েরই? মানব-মানবীর পছন্দ-অপছন্দই কী সম্পর্কসূত্রের শেষ কথা? সবকিছু? সাদামাটা প্রসঙ্গ-পরিচয়টাই কি নিবিড়, সঞ্চারী— স্থিতিস্থাপক হতে পারে না? সংঘাত ও সঙ্গমই কী— নারী ও পুরুষের চরম পরম অভিজ্ঞান? প্রকাশ্য নীতিনির্ধারক? চূড়ান্ত পদক্ষেপ?
জানি, বিদ্দ্যুল্লতা খেলে গেলে শূন্যে বজ্রপাত হয়, নদীতে জোয়ার এলে দুকূল উপচে পড়ে, ঢেউ তীরে আছড়ে পড়লেও কিন্তু ফিরে আসে সাগরের বুকে, উপকূলে জলোচ্ছ্বাস একা নয় সঙ্গে সওয়ার হয় ঘূর্ণিঝড়৷
ভুলের পিঠে কী থাকে: মন্দ, ক্ষয়-ক্ষতি, ভালো নয়?
কেন যে অঝোরে কান্না পেল! সশব্দে বুকের ভেতর থেকে আষাঢ় শেষে শ্রাবণ নামলো!
মেঘের বুক পকেটে পালক গুঁজে আমার মনপাখি ওড়ে প্রাবৃট-আকাশে৷ তার পাখার ঝাপটে মেঘের সাজ ভেঙে মধ্যদিনে বৃষ্টি নামে মনপবনে, আমার একান্ত ভুবনে ভুবনে৷ মনের অজান্তে, কোনো এক অজানায়— আমি আর নির্ভুল ভুল মধ্য দুপুরের মাঝ দরিয়ায় ভেসে যাই সেই শাঙন-ঝর্ণায়৷
নস্যি না হলেও, এক পশলা বৃষ্টির মতো ছোটো একটি ঘটনা৷ বৃষ্টির ছাঁটের মতো একটি তিলমাত্র ঘটনা৷ জনান্তিকে বেসামাল আমাকে থামিয়ে দেয়৷ এক মধুর মৌহূর্তিক যাওয়া-আসা আমাকে পুলকিত করে৷ আমি তার কাছে এক তাল ঋণী হয়ে গেলাম! কে সে, খ্যাপা মুষলধারার মতো আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল? এক মিঠে দুর্ঘটনার বাতাবরণে আমাকে আচ্ছাদিত করে গেল৷ আমার পায়ের নিচে অমীমাংসিত চরণচিহ্ন৷ মাথায় অসমাপ্ত সমাপ্তি৷
পুলক বড়ুয়া । বাংলাদেশ
-
গল্প//উপন্যাস
-
27-12-2019
-
-