অটোয়া, বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল, ২০২৪
ভর - আশিস চক্রবর্তী

    কি কেমন লাগছে ক্লাস করাতে? -জিজ্ঞাসা করলেন সুবীর বাবু।
    বললাম- ভালোই। ছাত্ররা বেশ বাধ্য।
     -নতুন তো,আস্তে আস্তে সব টের পাবেন।
     -মানে? হই হট্টগোল করে বুঝি?
     -আরে বাবা কয়েক বছর যাক। জীবনে এক ঘেয়েমি আসুক। চোখে খালি রাত আর সকালটুকু দেখতে পাবেন। হুস করে কখন গোটা দিনটা বেড়িয়ে যাবে, টের ও পাবেন না। আর আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের যা ফিডব্যাক পাবেন তাতে বেশি দিন ধৈর্য থাকবে না। এই আমি নতুন যখন এসেছিলাম ক্লাসের অতিরিক্ত নিজের যা ছিল নিংড়ে দিয়েছি। নিট ফল কি? বিগ শূন্য। কই একজন কেউ পঞ্চাশের ঘরে আজ অব্দি যেতে দেখলাম না। তাও পাস ফেল নেই। ভাবুন থাকলে আপনার থেকে ছাত্ররা বয়েসে বড়ো হতো।
     এরপরে হা হা হা হা হা করে হেসে ফেটে পড়লেন।
     সুবীর বাবুর কথা গুলো ফেলবার নয়। এই কদিনেই যা বুঝেছি ওরা ক্লাসের থেকে ভাত ফুটে ওঠা গন্ধটাকে বেশি ভালো বাসে। টিফিনের আগের পিরিয়ডটাই ওদের আটকে রাখা যায় না। কখন গিয়ে খাবার লাইনে দাঁড়াবে এই চিন্তা। শেষের দিকে অর্ধেকের বেশি ছাত্র উধাও। প্রায় প্রত্যেকেই আর্থিক দিকে থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের, ফাস্ট লার্নার। এদের থেকে বেশি আশা করা এক প্রকার অন্যায়। সুবীর বাবুর কথার উত্তরে বললাম- কেন ক্লাস সেভেন এর মালা নামের মেয়েটি তো বেশ ভালো মনে হলো। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। ডেইলি পড়া করে আসে।
     হ্যাঁ। এটা ঠিক মার্ক করেছেন। এই তো কয়েক মাস হলো এখানে ভর্তি হয়েছে। রেসপন্স করে ভালো। ওই একটি মেয়ের নাম সকলের মুখেই শুনেছি। দেখুন কতদিন পান ওকে। - বললেন সুবীর বাবু।
     -কেন? কতদিন পান মানে? আবার চলে যাবে নাকি?
     -বেশির ভাগই তো হয়, বিয়ে হয়ে যায় অজান্তে কিংবা পড়ার পাঠ চুকিয়ে কাজে ঢুকে পড়ে। এরকম অনেককেই দেখলাম চাকরী জীবনে। কত ব্রাইট স্টুডেন্ট এভাবে হাত ছাড়া হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যাক গে ওসব কথা। তা আপনি আছেন কোথায়?
     -বাড়ি ভাড়া পেয়েছি। কাছেই। পার্থ বাবু সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
     -যাক বেশ ভালো। স্কুলের কোনো ব্যাপারে কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না। আমি আপনার দাদার মতো, ওকে।
    বললাম - নিশ্চয়।
     বেকারত্বের জ্বালা থেকে মুক্তি পেলেও পোস্টিংটা মনের মতো জায়গায় হয়নি। একেবারে দুটো ডিস্ট্রিক্ট টপকে এই দেবী পুরে। মফস্বল । সবই আছে। তবুও আমার জন্মভূমির মতো নয়। কর্মভূমি আর জন্মভূমি একই স্থানে সে সৌভাগ্য কজনের হয়? বিকেলের ফাঁকা সময়ে পার্থ বাবুর বাসায় যাই, এটা ওটা নিয়ে আড্ডা চলে। অদ্ভুত মানুষ। ভদ্রলোক সন্ধ্যে বেলায় কাঁচের শিশি আর কাঠের খোপ বাক্স নিয়ে বারান্দায় হোমিও প্যাথি প্র্যাকটিস করেন। পাড়ার লোকে তাতে সাড়াও দেয়। তিনি বলেন রিটায়ারমেন্ট এর পর একটা ক্লিনিক খুলে বসবেন। এখন নো ব্যবসা। কেবল প্র্যাকটিস। হাত যশ খুলে গেলে বাকি জীবন উপরী কিছু পাওনা প্লাস সময় পাশের ভালো উপকরণ নাকি হোমিওপ্যাথি।
     সোমবার দিন ক্লাসে ইউনিট টেস্টের রেজাল্ট জানানোর সময় সকলের উদ্দেশ্য কয়েকটা কথা না বললেই নয়, ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখি। বললাম- নেক্সট টেস্টে আমি সকলের রেজাল্ট মালার মতো দেখতে চাই। কারো কোনো অসুবিধা হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো। সকল শিক্ষক মশায় তোমাদের জন্য সর্বদা আছেন। দরকার পড়লে আমরা এক্সট্রা ক্লাস নেবো। এভাবে পড়লে কোনো লাভ নেই, বেশিদূর এগোতে পারবে না। একই ক্লাসে মালা এতো ভালো রেজাল্ট করছে তোমাদের দেখে শেখা উচিত। ও তো একটা অনুপ্রেরণা।
    আমার সমস্ত কথা শেষ হবার পর থমথমে ক্লাসের পেছন বেঞ্চ থেকে একজন বলে উঠলো,
     - মালার মত আমরা পারবো না স্যার
     বললাম - কেন, একথা বলছো কেন? চেস্টা করো। ক্লাসে যা পড়ানো শেখানো হচ্ছে সেগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করো। তুমিও পারবে। সকলে পারবে।
     এবারে সামনের দিকের একজন ছাত্রী উঠে দাঁড়ালো। বললাম কিছু বলবে? 
     -স্যার একটা কথা বলবো। বলছি আমরা মালার মত কেউ পারবো না। ওর মা ওকে সব বলে দেয়। তাই ও পারে। - বললো মেয়েটি।
     - তাতে কি হয়েছে । তোমরাও তোমাদের মা-র কাছে জেনে নেবে।
     - আমাদের মায়েরা পারবে না। সকলেই প্রায় চিৎকার করে বললো। 
     - আস্তে আস্তে, এভাবে চিৎকার করোনা। বসো প্রত্যেকে। আমি আছি তো আমার কাছে জেনে নেবে।
     পরীক্ষায় কি আসবে সেটা আপনি আগে থেকে বলে দেবেন স্যার? -একজন প্রশ্ন করলো।
     - তা কি করে হয়! আমি গোটা চ্যাপ্টার পড়িয়ে বুঝিয়ে দেবো। তার থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন দেবো নিশ্চয় পারবে।
     - ওর মা ঠিক কোন প্রশ্ন গুলো আসবে সেটা মালাকে আগে থেকেই বলে দেয় স্যার।
     - এও কি হয় নাকি। এসব ভুল ধারণা। কোন কোন প্রশ্ন ইম্পরট্যান্ট সেটা অনুমান করা যায় সেটা সত্য। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রশ্ন পত্র কেউ বলে দিতে পারে নাকি?
     -পারে স্যার পারে। ওর মা সব পারে।
     কথা গুলো শুনে হাসি থামাতে পারলাম না। মালাকে বললাম কি মালা তোমার মা ম্যাজিক জানে নাকি?
    মালা কেবল মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো।
     সেই পেছন বেঞ্চের ছেলেটি দাঁড়িয়ে বললো- স্যার জানেন ওর মা এর কালির ভর আসে, ওতেই ওর মা সব ওকে বলে দেয়।
     এই কথা শোনার পর মালা মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লো। আমার শত শান্তনাতে কোনো ফল হলোনা। বেশ সেনসিটিভ। ক্লাসের ঘন্টা পড়াতে, নিরুপায় হয়ে বেরিয়ে যেতে হলো। এরপর থেকে আর সেভাবে মালা রেসপন্স দিতো না। মাটির দিকে চেয়েই বেশি সময় থাকতে দেখতাম। ভেতরে ভেতরে ওর মা এর ব্যাপারটা ওকে ক্রমশ নিস্তেজ করে দিচ্ছে বুঝতে পারছি।
    একদিন টিফিনের সময় ইচ্ছে করেই স্টাফ রুমে মালার ঘটনাটা নিয়ে সবার সামনে কথা পারলাম।
    -সুবীরবাবু মালাকে কয়েক দিন লক্ষ্য করেছেন?
    -হ্যাঁ শরীর টোরির খারাপ বোধহয়।
    সুবীর বাবুকে সেদিনের ক্লাসের ঘটনাটা জানিয়ে বললাম- এটা নিয়ে কিছু করা যায় না।
    -কি করতে চাও তুমি বলো? প্রশ্ন করলেন সুবীর বাবু।
    -এই ধরুন ওর বাড়ির লোকের সাথে মিট করা। বোঝানো।
     বারিন বাবু বলে উঠলেন লাভ কিছু হবে না। বুঝলে। আমি অনেক চেষ্টায় করেছি। উল্টে বিপদ অনেক বেড়েছে।
     আমি বারিন বাবুর কাছে পুরো ঘটনাটা  জানতে চাইলে উনি বলেন-
     শোনো আমি বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সদস্য। আমাদের টিম এ রকম বুজরুকির খবর শুনলে সেখানে ক্যাম্পেন চালিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলে। এই নবাগত কালি মাতার আবির্ভাব নিয়ে সেখানে অনেক ধরনের জন সচেতনতা মূলক প্রোগ্রাম করি। উল্টে গত মাসে গ্রামের লোকজন হেডমাস্টারকে কমপ্লেন করে যায়। আমরা নাকি ধর্মাচরনে বাধা দিচ্ছি। আমি তবুও দমিনি। এসব কাজে এরকম বাধা বিপত্তি হুমকি আসে। আমাদের বিজ্ঞান মঞ্চের মুখপত্র "নব জাগরণ" পত্রিকায় নিয়মিত এই ব্যাপারে লিখতে থাকি। গ্রামের প্রতিটি মানুষের হাতে তুলে দি, একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে যা করার করি। তবে শেষটায় ওখানে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আমার স্কুল পর্যন্ত সেই ঝামেলা এসে গড়ায়। স্কুলের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে এই ভেবে আমাকে থামতে হয়েছিল। সেই আদি কাল্ থেকে বুঝলে এই বাংলার মানুষ চরণামৃত আর জবা ফুল মাথায় ছুঁইয়ে বেঁচে আছে। আর তার জন্য গুরুজী বাবাজিরা করে খাচ্ছে। দিন দিন পসারও বাড়ছে। কিছু টি করতে পারবে না।
    পার্থ বাবু এতোক্ষণ পেপার পড়ছিলেন। মাঝখানে বারিন বাবুকে থামিয়ে বললেন- এসব আপনি যাই বলুন বারিনদা, এটা এক প্রকার মানসিক রোগ। আসলে প্রেতাবিষ্ট ও দেবাবিষ্টদের মধ্যে বেশির ভাগটাই ভুগছে হিস্টিরিয়া ও স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে। এই সব রোগীদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। রোগীদের পরিবারে ধর্ম প্রবণতা প্রবল। কুসংস্কার ও প্রচুর। বলা বাহুল্য হিন্দুদের মধ্যে এই রোগীদের পরিমান বেশি দেখা যায়। দেখবেন, মেয়েরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন। পুরুষের সংখ্যা কম।  অনেক ক্ষেত্রে একটা পূর্বের কোনো ভয়ানক স্মৃতি বা ইতিহাস এই সমস্ত রোগের কারণ হতে পারে। আবার কেউ কেউ পাড়া প্রতিবেশীর কাছে নিজেকে মহৎ বা অন্যতম ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রকাশ করার জন্য এই জাতীয় অভিনয় ও করে থাকে। তবে বারিন বাবুর কথা সত্য। গ্রামাঞ্চলে এই সবের ভেতর মাথা গলানো মানে, বিপদ ডেকে আনা। ধর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যাপার কিনা। তুমি নতুন এসেছো, এসব থেকে দূরে থাকাই ভালো। তা ছাড়া মুখে বলে এসব তুমি আটকাতে পারবে না। দেহে আসা মা কালিকে তুমি যদি চিকিৎসার কথা বলো তবে তো হয়েইছে। চারিদিকে গেল গেল রব উঠবে, আর রে রে করে সকলে তেড়ে আসবে। কারো সাহায্যটি পাবে না।
     একটা মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণার কাছে আমাকে থেমে যেত হলো। আফসোস শুধু রয়ে গেল, মালা আর বাকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। নিয়মিত ভাবেই ক্লাস চললো। মালাকে ক্রমশ দিনের পর দিন সংকুচিত হতে দেখছি। ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে প্রায় সরেই গিয়েছিল হটাৎ একদিন সন্ধ্যে বেলা আমার খোঁজ নিতে নিতে মালা পার্থবাবুর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। মালার ঘর্মাক্ত শরীর আর হাঁপিয়ে ওঠা নিঃশ্বাসে মাখা কথাগুলোর মর্মার্থ যা বুঝলাম তাতে আমি আর পার্থবাবু ছুটে গেলাম মালার বাড়ি। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, মালার মায়ের অবস্থা শোচনীয়। কপালের এক জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। অনাবৃত শরীরের কয়েক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন। এবং মালার মা চিৎকার করে বলছে- আমাকে ছেড়ে দাও, আমি চলে যাচ্ছি, পন্ডিত এর কাছে আমি যাবো না। তড়িঘড়ি মাথায় জল ঢেলে খানিক আশ্বাস ও অভয় দিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে সদর হাসপাতাল ভর্তি করি। মালার পিতা আনন্দ মাঝির কাছ থেকে তার স্ত্রী শান্তির কালি হয়ে ওঠা মানে ভর হওয়ার ইতিবৃত্ত শুনলাম।
     প্রায় পনের বছর আগে আনন্দ মাঝির সাথে শান্তির বিয়ে হয়। আনন্দ প্রাইভেট কোম্পানির চাকরী করতো। কোম্পানি উঠে যাওয়ায় তিনটি সন্তান নিয়ে শশুরের সংসারে অবাঞ্চিত অতিথি। কয়েক মাস বেকার। শশুর মশায় এর অবস্থা খুব একটা ভালোনা। এর ওপর অনেক পনের দাবি ছিল আনন্দ মাঝির বিবাহ কালীন। সে কারণে তাকে ভালো নজরে দেখত না। আনন্দর ঘর জামাইএ ইচ্ছে নেই। সে কারনে শান্তিকে কিছু মাস ধরে বলে যায় যে তার বাপের কাছে কিছু টাকা ধার নিতে যাতে সে নতুন কিছু ব্যবসা করতে পারে। এতে শান্তি পূর্বের পনের কথা ভেবে রাজি হয়নি। শান্তিকে রাজি করাতে না পারায় প্রায় রাতে দুজনের ঝগড়া হতে থাকে। একদিন সে আত্মঘাতী বা দেশান্তরীর ভয় দেখায়। সেই রাতেই শান্তির কালি মন্দিরে প্রথম ভর আসে। মন্দিরের পাশে আলাদা ছাউনি তুলে শান্তির ঘর নির্মাণ করা হয়। সেই সময় তার চেহারা দেখলে ভয় এ ভক্তি হওয়া গ্রাম বাসীর কাছে স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে পসার জমে ওঠে। গ্রামের লোকের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শান্তি আর আনন্দের নতুন জীবন জীবিকা। এদিকে মন্দিরের পুরোহিত  শ্রী ধর ভট্টাচার্য এর পসার কমে আসে। মন্দিরের পূজার উপকরণ ফল মূল মিষ্টান্ন দক্ষিনা সমস্ত কিছু জরো হতে থাকে শান্তির পা এর গোড়ায়। ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে আনন্দ মাঝির পরিবার। শ্রী ধর পন্ডিত চিন্তিত হয়েই গোটা গ্রাম বাসীকে আজকে জানায় কালি নয়, কোন দুষ্ট আত্মা ভর করেছে শান্তির ঘাড়ে। এখনই ঝাড় ফুঁক দরকার। শেষে ছাউনি থেকে শান্তিকে নামিয়ে হাত পা বেঁধে দুষ্ট আত্মার সঠিক পরিচয় জানার চেষ্টা চললো। আনন্দের মুখে যা শুনলাম ফুটন্ত তেল ও গরম লোহার ছেকা দেয়া হয়। তার আগে অবশ্য মৃদুতম পদ্ধতিতে অর্থাৎ জুতো ঝাঁটার আঘাত দিয়ে চেষ্টা করা হয়ে ছিল। পন্ডিত ও ওঝা ডেকে চব্বিশ ঘন্টা ধস্তাধস্তিতে ও কোনো ফল মেলেনি। শান্তি দাঁতে দাঁত কামড়ে নিজেকে কালি প্রতিস্থাপন করার চেষ্টায় পরে ছিল। এর পর মালা এসে আমাদের খবর দেয়।
     সমস্তটা শুনে আমরা পাথরের মত হয়ে গেছি। পার্থ বাবু বললেন- শান্তি মাঝির বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। নিষ্কর্মা স্বামী, সংসার ছেলেপুলে, অন্যদিকে বাবার স্বামীর প্রতি খারাপ আচরণ, আর্থিক কষ্ট সমস্ত কিছুর নিরসন করেছেন একটি মাত্র উপায়ে, কালীর ভর। এটাকে হিস্টিরিয়া বলা চলেনা। বরং আমি বলবো যস্মিন দেশে যদাচার, কি বলো ভাই?
     এখন কি বলা উচিত সেটা কিছুতেই মাথায় এলোনা। তবে দেবতার ভর কিনা জানি না। তবে দারিদ্রতায় আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার চেষ্টায় ভর শান্তি মাঝির এসেছিল ঠিক, সেটা সত্য। বিজ্ঞানও তাকে অস্বীকার করতে পারবে না। ভর শব্দের আভিধানিক অর্থ অবলম্বনও বোঝায়। সে ক্ষেত্রে দেবী শান্তি মাঝির ওপর ভর করেনি, বরং শান্তি মাঝিই দেবীর ওপর ভর করে জীবন যুদ্ধে বিজয়িনী হবার চেষ্টা করেছে।
     কয়েক দিন পর আনন্দ মাঝির কাছে জানতে পারি স্ত্রী সুস্থ্য আছে, তবে এতদিন কালির ভরে যা রোজগার করে ছিল স্ত্রীর চিকিৎসায় সবই প্রায় শেষ। আবার সেই দৈন দশাতেই ফিরে গেছে। এখনো কোনো কাজ জোটেনি আনন্দের।
     অনেক দিন মালা প্রায় আসে না। ভাবলাম মা অসুস্থ্য তাই সেবা যত্ন করছে। সে ব্যাপারে অন্য ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদও করিনি। যদি এসব উটকো ব্যাপারে ওদের ওপর প্রভাব পড়ে এই ভেবে। মালার অনুপস্থিতির হার ক্রমে বেড়ে গিয়ে মাস ছাপিয়ে গেলো। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে হয়তো তারা এখান থেকে চলে গেছে। আরো একটা ব্রাইট স্টুডেন্ট অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। একদিন সন্ধ্যে বেলায় পার্থবাবুর সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি হঠাৎ ভীষণ জোরে জোরে ঢাক ঢোল পেটানো আর উলূ, শঙ্খ, কাঁসর ঘন্টা ধ্বনির শব্দে কান  প্রায়  ফেটে যাবার জোগাড়। চারিদিক থেকে লোকেরা ওদিক টাই ছুটে যাচ্ছে। পার্থবাবু কে জিজ্ঞাসা করলাম- কি হলো বলুন তো?  ভূমিকম্প নাকি?
     পার্থবাবু বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে বললেন বেশি দূরে নয় ওই তো ওখানে জমায়েত। চল ভাই দেখে আসি।
     ভিড় লক্ষ্য করে এগিয়ে  গিয়ে দেখি ভিড় ছাপিয়ে এক ভদ্রলোক এর বাড়ির উঠোন ভরে গেছে । কোন মতে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখি তুলসী মঞ্চের সামনে এলো চুলে, রক্ত রাঙা চোখ নিয়ে  আমার সেই ব্রাইট স্টুডেন্ট মালা মাথাটা অনবরত ডানে বামে ঘোড়াচ্ছে। অনেক বার মালার নাম ধরে ডাকলাম, শরীরের সমস্ত শক্তি উজাড় করে ভয়ানক চিৎকারে চারিদিক স্তব্দ হয়ে গেল। তবুও মালা  কিছুতেই সাড়া দিলো না।

আশিস চক্রবর্তী । ভারতবর্ষ
গল্পটি লেখার অনুপ্রেরণা ভবানিপ্রসাদ সাহু মহাশয়ের "দুই বাংলার কু সংস্কার বিরোধী বিজ্ঞানচিন্তা" গ্রন্থটি।