অটোয়া, মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
সুন্দরবন ভ্রমণ - নীরেশ দেবনাথ

(এক)মাদের সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যাপারটা হঠাতই ঠিক হলো। পরের দিন শনিবার সকাল ছয়টায় আমরা রওনা হলাম। প্রথমে সোদপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরলাম। নৈহাটি-বজবজ লোকাল। দমদম স্টেশনে ট্রেন পাল্টে শিয়ালদা পৌঁছুলাম। তারপর শিয়ালদহ থেকে সাতটা বিয়াল্লিশের ক্যানিং লোকাল ধরে  ক্যানিং স্টেশনে পৌঁছুলাম। সেখান থেকে অটোতে করে গদখালি। সেখানে ট্রাভেল এজেন্সির লোক আমাদের লঞ্চে বসিয়ে দিল। লঞ্চে মোট ৩৫ জন যাত্রী।
     আমাদের ১৪ জনের দু'দিনের সফর ছিল আর বাকি ২১ জনের তিন দিনের সফর। ট্রাভেল এজেন্সির দুজন সদস্য আমাদের সাথে ছিল। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল সজনেখালি। এটিই সুন্দরবনের প্রকৃত  প্রবেশদ্বার। প্রথমে সজনেখালি ফরেস্ট অফিস - এবং  রিজার্ভ ফরেস্ট। আমাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা আমাদের পরিচিতি পত্র সমস্ত এখানে জমা দিয়ে তারপর আমাদের এগোতে হলো। অবশ্য এই জমা দেয়ার কাজটা আমাদের করতে হয় নি।  এজেন্সির লোকই সমস্ত কিছু করে। এখানে একজন গাইড আমাদের সাথে যুক্ত হলো।
     এখানে বিরল প্রজাতির কচ্ছপের একটা pond, তারপর একটা ওয়াচ টাওয়ার ক্রোকোডাইল পন্ড এই সমস্ত কিছু দেখে আমরা এখান থেকে আবার লঞ্চে এসে বসলাম।
     সেখান থেকে নিয়ে গেলো গোসাবা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলো বাড়ি, হ্যামিল্টন সাহেবের বাংলো দেখা হল। গোসাবা থানার পাশেই রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের বাংলো - কাঠের তৈরি, খুব সুন্দর পরিষ্কার, ছিমছাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি আছে এবং হ্যামিলটন সাহেবেরও মূর্তি আছে। তবে বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করা গেল না কারণ সেটা এখন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়।
     এখান থেকে আবার লঞ্চ এসে বসলাম। সজনেখালি থেকে আমাদের সাথে একজন গাইড সাথে সাথেই সর্বক্ষণের জন্য ছিল। গাইড এখানকার লোকাল ছেলে। আমাদের সাথে সাথে ডাইনে-বাঁয়ে কোথায় কি, কোন্ জঙ্গল, কোন্ লোক্যালিটি সমস্ত বর্ণনা দিতে দিতে চলল। সুন্দরবনের জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশের কোন পারমিশন নেই। জলবিহার। ওয়াটার সাফারি। অর্থাৎ লঞ্চে করে জলে জলে সমস্ত কিছু দেখতে হবে। লঞ্চ থেকে নাবার কোন  উপায় নেই আমাদের।
     সন্ধ্যে বেলায় লঞ্চ এসে যে জায়গাটায় এসে ভিড়ল সেই জায়গাটার নাম পাখিরালয়। কিন্তু লোকাল লোকেরা এটাকে পাখিরালা বলেই বলে এবং লেখে। এই পাখিরালাতে সুন্দর সাজানো গোছানো হোটেলে আমাদের এনে তুললো। আমরা তিনজন - আমি আমার ছেলে জিৎ ও তার মা আর আরো একটি ছেলে স্নেহাশীষ - আমাদের চারজনকে দুটো রুম - রুম নাম্বার এইট ও নাইন-এ থাকে দিলো। সত্যি সুন্দর সোসাইটির মতন ছিমছাম হোটেলটি। গেটের পাশে হোটেলের অফিস থেকে হোটেলের নিজেদের তৈরি সিমেন্টের রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট অনেকগুলি কটেজ তৈরি করা আছে। কটেজ গুলোর উপরে খড়ের ছাউনি কিংবা টালির চালা নয়, সম্পূর্ণ সিমেন্ট দিয়েই ঢালাই করা।শেষের দিকে তিন তলা বিল্ডিং, ডাইনিং  হল। ওদের নিজস্ব রাস্তার দু'পাশে সুন্দর ফুলের বাগান - এরপরে কটেজগুলো। প্রত্যেকটি কটেজ থেকে এ রাস্তায় এসে অন্য ছোট রাস্তাগুলি মিশেছে। এত সুন্দর হোটেল আমি সচরাচর দেখি নি। কিছু কিছু ফাঁকা জায়গা আছে যেখানে, সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। আমাদের সাথে যারা ছিল সেই ট্রাভেল এজেন্সির লোক ঝুমুর নাছের ব্যবস্থা করেছে। পাশে ছিল বাউল গীতির  অনুষ্ঠান। আমাদের গ্রুপের একটি ছোট মেয়ের বার্থডে ছিল সেদিন। বার্থডে সেলিব্রেশন হল। তারপর রাত সাড়ে নটার সময় ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া। ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন, মিষ্টি। কাল সকাল সাড়ে ছয়টায় রওনা হতে হবে জানিয়ে দিলো ট্রাভেল এজেন্সি লোক বাপি আর বিজয়। তারপর আমরা যে যার রুমে প্রবেশ করলাম। তারপর ঘুম। পরের দিনের জন্য রেডি হতে হবে তো!
     দ্বিতীয় দিন। সাড়ে সাতটার দিকে  লঞ্চ ছাড়লো। আবার জলবিহার। আজ একদম সুন্দরবনের জঙ্গলের ভেতর যে নদী নালা খাল আছে আমাদের সেখানে নিয়ে গেল। গাইড বিভিন্ন বর্ণনা দিতে থাকলো। নদীর নাম, বাঁদিকের জঙ্গলের নাম, ডানদিকে জঙ্গলের নাম, কতকিছু। গাইড অনেক কিছু বর্ণনা করার পর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম বনবিবি সম্বন্ধে কিছু জানলে যেন বলে। সে বনবিবির সম্বন্ধে অনেক কিছু বলল। বনবিবির কথা আমি পরের দিন লিখব । আজ থাক। লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। লঞ্চেই রান্নার সমস্ত ব্যবস্থা আছে। ওদের কাজই যাত্রীদের খাবার ব্যবস্থা করা। জোয়ারের জল দেখতে দেখতে বেড়েই চলল। এখানে তো সমুদ্রের খুব কাছাকাছি তাই জোয়ার-ভাটা খুব নজরে আসে। স্পষ্ট বোঝা যায়।
     বাঘের দেখা কিন্তু পাওয়া গেল না। গাইড বলল বাঘের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল, প্রায় অসম্ভব। কারন আজকাল নাইলনের নেট লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও মাঝে মধ্যে লোকালয়ে বাঘ ঢুকে পড়ে। কিন্তু যাইহোক - বাঘের দেখা পাওয়া গেল না। হরিণ কুমির দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। কিন্তু দু'পাশের জঙ্গলের সৌন্দর্য ! তা অন্যান্য যেসব ফরেস্ট আছে বা দেখেছি তার সাথে সুন্দরবনের তুলনা চলেনা। সুন্দরবনের একটা আলাদা মাধুর্য আছে। একটা আলাদা মাত্রা আছে। মাইলের পর মাইল দু'পাশে জঙ্গল। উচ্চ বৃক্ষ জাতীয় গাছের এখানে দেখা নেই ঠিকই কিন্তু এই জঙ্গল সত্যি সুন্দরী, সত্যি সুন্দর। এইজন্য নামই হয়েছে  সুন্দরবন, জঙ্গলে সুন্দরী গরান গেওয়া খুব বেশি লম্বা হয় না। হেতাল তো দূর থেকে দেখতে নারকেল গাছের চারার মত লাগে। অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ জাতীয়।  সমুদ্রে যেখানে বড় বড় নদী এসে মেশে অর্থাৎ মোহনা - সেখানে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের দেখা পাওয়া যায়। এই সৌন্দর্য যার কোন তুলনা হয় না। সুন্দরবনের সৌন্দর্য শুধু সুন্দরবনের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে।

(দুই) ভারতবর্ষের বেশিরভাগ রিজার্ভ ফরেস্ট, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, পাখিরালয় কমবেশি প্রায় একই রকম দেখতে। বড় বড় গাছ, তৃণভূমি, ছোট বড় টিলা, পাহাড়ি ছোট নদী থাকে। সাথে থাকে একটা লাইফ স্যাংচুয়ারি। অর্থাৎ বলতে চাইছি একটা অভয়ারণ্যের সাথে অন্য     অভয়ারণ্যের খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। কিন্তু এই সুন্দরবন তাদের সকলের চেয়ে আলাদা। অনন্যা। এখানে তৃণভূমি নেই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার কোনো উপায়ও নেই। চতুর্দিকে খাল আর খাল, জল আর  জল, নদী আর নদী। শুধু জলবিহার। ওয়াটার সাফারি। শুধু লঞ্চে করে যাতায়াত করা, নেমে কিছু দেখা যাবে না। বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া লঞ্চ থেকে কেউ ডাঙ্গায় নামতে পারবে না।

     তা নামতে না পারলেও লঞ্চে থেকে নদী বা খালের দু ধরে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে খুশি হবে না এমন মানুষ বোধহয় কোথাও পাওয়া যাবে না। আমাদের লঞ্চের সকলেই খুব উৎসাহের সঙ্গেই গল্প ক'রে, গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে মহা আনন্দের সঙ্গে হৈ চৈ করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। একজন বাচিক শিল্পী ছিলেন। উনি আমার কয়েকটা কবিতা আবৃত্তি করলেন। সকলের খুব ভালো লাগলো। এইভাবে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেলো টেরই পেলাম না।
     দোবাঁকিতে আধ কিলোমিটার লম্বা একটা skywalk দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা টাওয়ার। তার মাথায় উঠে চতুর্দিকে মনোরম দৃশ্য দেখা গেলো। Forest Department-এর nursery-তে ম্যানগ্রোভ জাতীয় অসংখ্য চারা উৎপন্ন করে রেখেছে। গাইড জানালো এগুলি সবই গরান ও গেওয়া জাতীয় উদ্ভিদের চরা। কিন্তু যে সুন্দরী গাছের নামের সাথে সুন্দরবন নাম যুক্ত সেই সুন্দরী গাছের চারা উৎপাদনে তেমন উদ্যোগ দেখলাম না।
     এখানে skywatk থেকে নেমে ফেরি ঘাটের দিকে যেতে যেতে একটা ছোট পুকুর দেখলাম। এই পুকুরের জল মিষ্টি জল। তার চারপাশে আমাদের গ্রাম বাংলার যে সমস্ত গাছ-গাছালি, ফুল গাছ ইত্যাদি থাকে তার মধ্যে বেশ কিছু  গাছ দেখতে পেলাম। আম গাছ, পেয়ারা গাছ, কলা গাছ, জবা ফুল, মরসুমী ফুল গাছ দেখতে পেলাম। পুকুরের একপাশে ফরেস্ট গার্ডদের থাকার জন্য কোয়াটার বানানো আছে। এই গাছ-গাছালি গুলি ফরেস্ট গার্ডরাই পরিচর্যা করে বড় করেছে। এই পুকুরে দু-তিন জনকে স্নান করতে দেখলাম। আমি জিজ্ঞেস করায় বলল, হ্যাঁ, এই জলটা মিষ্টি জল। এটার পার একটু উচু করে বানানো থাকাতে সমুদ্রের লোনাজল প্রবেশ করতে পারে না। হরেক রকম ফুল ও ফলের গাছ দেখা গেলো এখানে।
     এখন থেকে ফেরিঘাটে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের লঞ্চ দুটো লঞ্চের পরে এসে ঘাটে ভিড়ল। আমরা সকলে আস্তে আস্তে  উঠে পড়লাম। তারপর এখান থেকে লঞ্চ আবার জঙ্গলের ভেতর দিকে খাল বেয়ে এগিয়ে গেল। সুন্দর সুন্দর গাছ-গাছালি, অবশ্য সবই প্রায় একই ধরনের। এগিয়ে চললাম আর গাইডের মুখে বনবিবির কাহিনী মন দিয়ে শুনতে শুনতে বিভোর  হয়ে গেলাম।
     তারপর ফেরার পালা। আমরা এই লঞ্চের ১৪ জনের আজকেই ভ্রমন শেষ।  পাখিরালা পৌঁছে সেখান থেকে আমাদের ক্যানিং যাওয়ার পথ ধরবো।
     দেখতে দেখতে পাখিরালা ঘাটে এসে আমাদের লঞ্চ ভিড়ল। আমরা যে ১৪ জনের ভ্রমণ আজকে শেষ হলো - তারা নেমে এলাম। অবশ্য অন্য সকলেও নেমে এলো। তারা হোটেলের দিকে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো। আর আমরা  অটোরিকশা ধরলাম। আমরা ১৪ জন এবং ট্রাভেল এজেন্সির দুজন লোক - মোট ১৬ জন দুটো অটোরিকশা করে পাখীরালা থেকে যাত্রা করে গোসাবা ফেরি ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। পাখিরালা থেকে গোসাবা ফেরিঘাট মাত্র ৭ কিলোমিটার রাস্তা। গ্রামের রাস্তা -  কিন্তু খুব সুন্দর। রাস্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা এসে গোসোবা বাজার পার হয়ে ফেরিঘাটের কাছে নামলাম। তারপর  স্পিডবোটে উঠলাম, সেখান থেকে নদী পার হয়ে গদখালি পৌঁছুলাম।
     গদখালী থেকে আবারও দুটো অটোরিক্সাতে আমরা এই ১৬ জন ক্যানিংএর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রায় এক ঘন্টা কুড়ি মিনিটের রাস্তা। ক্যানিং স্টেশনে এসে সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কেটে ট্রেনে এসে বসলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য। শেষ হলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমন। মনটা ভরে নিয়ে এলাম সুন্দরবনের স্মৃতি।
     অগুনতি নদী, খাল,  দু পাশের বাদা, আবাদা এসবের নাম গাইড বলে গেছে কিন্তু কিছুই প্রায় মনে নেই। তা না-ই বা রইলো মনে সেসব নাম। কি-ই বা হলো তাতে! মনের ভিতরে ছবির মত সাজানো রয়ে গেলো যে সুন্দরবনের মধু মাখা স্মৃতিটুকু! এই স্মৃতিটুকু থেকেই যাবে আমার বুকের ভিতরে! চোখ বুঁজলে যে দেখতে পাই সবই পর পর! মন দিক না যতই ধোঁকা, কিছু নাও যদি মনে থাকে - বুকের অন্তরের স্মৃতিগুলো কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবে না। এই স্মৃতিগুলো থেকেই যাবে অন্তরের একেবারে গভীরে। এইটাকেই বলে ভালো লাগা। এই ভালো লাগাটাই অক্ষয় হয়ে থাকে।সুন্দরবন ভ্রমণের এই ভালো লাগাটাই আমি রেখে দিলাম সযত্নে বুকের ভিতরে।

রচনাকাল -
09 মার্চ, 2022
নীরেশ দেবনাথ
পনিহাটি, পশ্চিমবঙ্গ