বুঁচকির ঠাকুর - কৃতিকণা চিনি
"আরে ছাড়... ছাড় বলতিচি চোকটা। ধিঙ্গি মেয়ে, নেচে নেচে বেড়াচ্চে। বললুম ঠোঙাগুলো গোছ কর, তা নয়... আরে ছাড়, সব পুড়ে যাবে তো!" বলে বুঁচকির হাতটা জোর করে টেনে চোখ থেকে সরিয়ে দিলো নারায়ণী।
সবে জিলিপিগুলো গরম তেল থেকে তুলে রসে ফেলছিল সে। সন্ধ্যা হতে না হতেই খদ্দের যেন উপচে পড়ছে, একা হাতে জিলিপি ভাজা, ওজন করা, পয়সা গুনে নেওয়া...
আজ চড়ক। গত তিনবছর মহামারীর ভয়ে মেলা বসেনি। এবছর তাই মানুষের ঢল নেমেছে মোচ্ছোব তলার মাঠ জুড়ে। নারায়ণীর খুদে দোচালায় লক্ষ্মী যেন নিজে এসে পাত পেড়ে বসেছেন।
"ও মা, মাগো, দেকো না ইদিকে।" নারায়ণী সাড়া না দেওয়ায় বাঁ-হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিতেই, "তবে রে মুকপুড়ি..." বলেই নারায়ণীর চোখ পড়ল বুঁচকির হাতের দিকে।
"তোর হাতে ওটা কি রা?" একমুখ হেসে বুঁচকি বলল, "ঠাকুর।"
বিস্ময়ে কড়াইয়ের গরম তেলের ওপর হাত ঘোরানো বন্ধ হয়ে গেল নারায়ণীর, "এটা আবার কি ঠাকুর রা বুঁচকি? সাদা দাড়িয়ালা বুড়া! এমন ঠাকুর তো জম্মে দেকিনি বাছা!"
"বড়দিদিমণির ঘরে ইয়া বড় একটা ছবি আচে গো... ইস্কুলের বারান্দায় ভাত খেতে বসলে দেকা যায়। মালা পরিয়ে চন্নন ফোঁটা দিয়ে সব দিদিমণিরা গান কচ্ছিলো একদিন, আমাদের লজেন পোসাদ দিয়েছিলো। মনে নেই, একটা লজেন তোমার জন্য নিয়ে এলুম?"
"তা কোতায় পেলি এই ঠাকুর?"
"রফিকুল দাদু দিলো।"
একে হাতের কাজ সামলে উঠতে পারছে না, অধৈর্য খদ্দেরদের মুখঝামটা শুনছে, তার ওপর বুঁচকির মিথ্যে কথা আর সহ্য হল না নারায়ণীর, ঠাস্ করে একটা চড় কষিয়ে দিলো বুঁচকির গালে, "মিছা কথা কওয়ার আর জায়গা পাউনি? রফিকুল দাদু দিছে? মোসলমান হয়ে তোকে ঠাকুর দিলো? ফ্যাল বলতিচি ওটা, হাত থিকা ফ্যাল।"
"ফেলিস নি রে নারায়ণী... উনি যে আমাদের সকলের প্রাণের ঠাকুর, রবি ঠাকুর!" ভিড়ের মধ্যে থেকে ককিয়ে উঠলেন গ্রামের বয়েজ্ হাইস্কুলের হেডমাস্টার রফিকুল ইসলাম।
"মোসলমানেরও আবার ঠাকুর হয়, এই পোত্থোম শুনলুম গো চাচা।" বিস্ফারিত চোখে জবাব দিলো নারায়ণী।
"উনি না হিন্দুর, না মুসলিমের। উনি সকল বাঙালির, সকল মানুষের।"
"মাফ করো গো চাচা, মুক্কু-সুক্কু মেয়েছেলা, সাধু-সন্নেসীকে নিয়ে অ-কতা কু-কতা কয়্যে ফেলিচি। কবে উনার পূজা, কয়ে দাও। পুরুতকে আগে থিকা কয়ে রাকবো 'খন।" বলে নারায়ণী হাতজোড় করে কপালে ঠেকালো।
"হ্যাঁ রে পাগলি। আজ তো ৩০শে চৈত্র, আর আসছে ২৫শে বৈশাখ ওনার জন্মতিথি। ওইদিন পুজো করিস ভক্তি ভরে। তবে পুরুত লাগবে না। বুঁচকিকে পাঠিয়ে দিস আমার কাছে, একটা গান শিখিয়ে দেবো, ওনার ছবিতে মালা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ওই গানটা গাইলেই হবে।"
"তা চাচা, বুঁচকি কইছিলো এ ঠাকুরের লজেন পোসাদ?"
এবারে হো হো করে হেসে উঠলেন রফিকুল চাচা। বললেন, "বেশ বেশ, লজন্সের ভোগই দিস। তবে রবি ঠাকুর জিলিপি ভোগ পেলেও খুশিই হবেন। নে, এখন তোর দোকান সামলা, ২৫শে বৈশাখ দেখা হবে রবি ঠাকুরের পুজোয়।"
কৃতিকণা চিনি
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
-
গল্প//উপন্যাস
-
16-05-2023
-
-