অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ডিজিটাল প্রতারক - তরুন কুমার মন্ডল

বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে দিননাথ বাবু তার স্ত্রীর উদ্দেশ্য গলা চড়িয়ে বলল "কই গো শুনছ? একটু এদিকে এসো তো"

তার বৌ সুখদাদেবী বাসন মাজতে ব্যস্ত, এই কথা যেন তার কানেই গেল না। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে দিননাথ  আবারও বলল, "কই গো শুনছ "

এবারে সুখদা চেঁচিয়ে বলল, "কি শুনব, কাজ করছি চোখে কি দেখতে পাও না? তা ছাড়া শোনার জন্য ওখানে যেতে হবে কেন, আমি কি কানে কালা যে শুনতে পাব না?"
দিননাথ বিরক্তির সাথে ঝিমিয়ে কাছে গিয়ে মৃদু ভাবে বলল  "বলছিলাম তোমার কাছে হাজার তিনেক টাকা হবে?"
সুখদা যেন চমকে উঠলো, খুব খারাপ কথা শুনলে মানুষ যেমন আঁতকে ওঠে, নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারে না সেই রকম, সুখদা হাতের বাসন মাজা বন্ধ করে অবাক নয়নে বলল "কি! কি বললে তুমি! টাকা?"

দিননাথ " হ্যাঁ, ভীষণ দরকার ছিল, বেতন পেতে তো এখনও দিন দশেক বাকি, পেলে না হয় নিয়ে নেবে"

সুখদা বাসন মাজাতে মন দিয়ে "তিন হাজার টাকা, 
কি এমন দরকার পড়লো শুনি?"

দিননাথ সহজভাবে "ওই যে সাহা মুদি, যার দোকানে আমরা মুদিখানার বাজার করি, তার মেয়ের বিয়ে তাই কিছু টাকা অ্যাডভান্স চেয়েছে, মাসে তিন চার হাজার টাকার বাজার তো আমাদের হয়েই থাকে, তাই ভাবছিলাম,"

- "থাক আর ভাবতে হবে না, তোমার লজ্জা করে না বৌ এর কাছে টাকা চাইতে, কিসের পুরুষ গো তুমি?
তাছাড়া আমি টাকা পাব কোথা থেকে, আমি কি ইনকাম করতে যায়, না আমার টাকার গাছ আছে?"

- "তোমার ভান্ডারে কিছু নেই, দুইহাজার ও কি হবে না?"

সুখদা আরও একবার কাজ থামিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল- "কোন ভান্ডার?"
দিননাথ মৃদু ভাবে, "লক্ষ্মীর ভান্ডার, হাজার দুয়েক দিলেও মানসম্মান রক্ষা হতো"

- "তোমার আবার মানসম্মান আছে না কি যে রক্ষা করবে! ওখান থেকে দুটাকাও তুলতে পারবো না।"

"ঠিকই বলেছ, যে তোমার সাথে ঘর বেঁধেছে তার মানসম্মান তো থাকারই কথা না, যেটুকু ছিল পঁচিশ বছর আগে ধুয়ে গেছে  "এই কথা মনে মনে ভেবে পরিস্থিতি অনুমান করে স্থান ত্যাগ করে কয়েক পা এগোতেই সুখদা গলায় স্বর একটু বাড়িয়ে বলল, আজ সুমন হোস্টেল থেকে ফিরবে মাছ টাছ এনো, আর হ্যাঁ পাঁচশোর দই নিতে ভুলনা ছেলেটা দই বড্ডো ভালোবাসে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো রান্না বসাবো।

বেলা আটটা থেকে দশটা বাজতে চলল তবুও বাজার এলো না, এলো একটি ফোন কল, সুখদা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল আননোন নাম্বার, কল রিসিভ করতেই সুমনের কন্ঠ ভেসে এলো, "মা কি করছো, বাবা বাড়িতে আছে? আমার ফোনটার চার্জ নেই, সুইচ অফ্ হয়ে গেছে, এ টি এম কার্ড ও সাথে নাই, এটা বন্ধুর নাম্বার।"

সুখদা "না নেই তো, বাজারে গেছে, কেন কি বলছিস, তোর তো আজ আসার কথা ছিল, কখন আসছিস?"

সুমন "না মা আসছি না, কয়েকদিন পরে আসবো, বলছি আমার কিছু টাকা লাগবে কলেজ আর হোস্টেলে দিতে হবে, এখনই। "

সুখদা "কতটাকা?"

সুমন "পনেরো হাজার টাকা এই নাম্বারে পাঠাও, এখনই পাঠাও আমি বন্ধুকে সাথে নিয়ে এ টি এম এর পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তাড়াতাড়ি পাঠাও।"

সুখদা "অতো টাকা তো নেই দশ হাজার হবে হয়তো,
কিন্তু এতো টাকা কেন লাগবে, এই তো কিছু দিন আগে কলেজে লাগবে বলে টাকা পাঠাতে বললি?"

সুমন,"সে পরে বলবো, এটাও কলেজ আর হোস্টেলে লাগবে, তাড়াতাড়ি পাঠাও, দাঁড়িয়ে আছি।"

সুখদা, টাকা পাঠানো ছেলের কাছে শিখেছিল, সে নিয়ে  তার কোন সমস্যা বা চিন্তা নেই কিন্তু চিন্তা হচ্ছে এই ভাবে টাকা পাঠাতে সুমন কখনো বলেনি তাকে, তাই সামান্য চিন্তিত, কি যে এমন হলো এতো দ্রুত এখনই টাকার দরকার!

যাইহোক আর বেশি না ভেবে ছেলের দেওয়া নাম্বারে দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে পথের দিকে চেয়ে আছে, সুমন তো আসছে না, বাজারের থলে হাতে দিননাথ কখন ফেরে সেই ভেবে।

আসলে দীননাথ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার জন্যই রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থেকে বেলা যখন দ্বিপ্রহর ছুঁইছুঁই তখন সুমনকে সাথে নিয়ে, বাপবেটা একসাথে মটর সাইকেলে করে সদর দরওয়াজা অতিক্রম করলে, তা দেখে সুখদা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো তখন তার মানসিক অবস্থা বর্ণনাতীত।

ছেলেকে দেখে আনন্দিত হবে, না অতোগুলো টাকার কথা আগে জিজ্ঞেস করবে, না সকালের বাজার দুপুরে কেন, সে অপরাধে স্বামীর ওপর ক্রোধাগ্নি বর্ষণ করবে, কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছে না।

সুমন কাঁধের ব্যাগ নামানোর সাথে সাথে সুখদা আশ্চর্যের সাথে বলল "হ্যাঁ রে সুমন তুই যে বললি পরে আসবো টাকা পাঠাও, তবে চলে এলি যে?"

সুমন ততোধিক অবাক হয়ে "কখন সে কথা বললাম? আমি তো তোমাকে ফোন করেনি, আমি তো বাবাকে কল করেছিলাম, ট্রেন ঘন্টা খানেক লেট তাই, না হলে কখন চলে আসতাম।"
এবারে সুখদা গলার স্বর বাড়িয়ে "কি বলছিস কল করিস নি! মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না, মায়ের সাথেও ইয়াকি? তুইঅন্য একটা মোবাইল থেকে ফোন করে বললি, আমার মোবাইল সুইচ অফ, এ টি এম কার্ড কাছে নেই, আমার পনেরো হাজার টাকা লাগবে,
হোস্টেল আর কলেজে দিতে হবে, আর এখন বলছিস ফোন করিস নি?"

মায়ের কথা বলার ধরণ আর ঘটনার গুরুত্ব বুঝে
সুমন সিরিয়াস হয়ে মৃদু ভাবে বলল "বিশ্বাস করো মা, আমি কোন কল করেনি, এই তো আমার ফোন চালু আছে, তাছাড়া টাকা তো দিলে কয়েক দিন আগেই আবার টাকা চাইবো কেন? কই দেখি কোন নম্বরে কল করেছিলাম?"

দ্রুত মায়ের হাত থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে সেই নাম্বারে কল করতেই বুঝতে পারে সেটা সুইচ অফ, সুমন তার মায়ের দিকে অবাক হয়ে বলে, "তুমি কি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছ?"
সুখদা ভারি গলায় বলে, "আমি তো তোর গালার স্বর চিনি, তোর কথা বলার ধরণ আমি জানি, এতো বড়ো ভুল আমার তো হবে না! "
সুমন, টেকনোলজি মা, আধু‌নিক টেকনোলজি গলার স্বর হুবুহু নকল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অপব্যবহার ভীষণ বেড়ে গেছে, এই কথা আসতে আসতে বাবাকে বলছিলাম, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে কয়েক লক্ষ টাকার প্রতারণা হয়েছে শুধু ভয়েস ক্লোনিং  করে, তাই সাবধান কেউ টাকা পাঠাতে বললে কল কেটে দিয়ে কল ব্যাক করে যাচাই করা প্রয়োজন বা ভি‌ডিও কল করে দেখে নেওয়া, বা অন্য কোন সোর্স কাজে লাগিয়ে কনফার্ম না হলে ঠকে যেতে হবে।"

একটু থেমে তার মায়ের দিকে চেয়ে, "তুমি টাকা পাঠাও নি তো মা?"
সুখদা দেবী আর কোন কথা বলার পরিস্থিতিতে ছিলো না জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেছে।

সুমন হতভম্ব হয়ে মায়ের মাথা টা কোলে তুলে তার ব্যাগ থেকে জল বের করে ময়ের মুখে ছিটিয়ে বলে "মা ও মা ..ও..মা ..ঠিক আছ তো, মা.।" 

দিননাথ বাবু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো, সুমনের উদ্দেশ্যে বলল, "তোর দিদিকে কল কর শশুর বাড়ি ছেড়ে কয়েক দিন মায়ের সেবা করে যাবে, এই টাকার শোক সহজে মিটবে না, তুই অতো চিন্তা করিস না কিচ্ছু হবে না"  আর মনে মনে বলল "কই মাছের প্রাণ। "

সুমন মোবাইল হাতে নিয়ে, উৎকণ্ঠার সাথে বলল "অ্যাম্বুলেন্স.."

তরুন কুমার মন্ডল
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ