সমুদ্রস্বপ্ন - হাসান গোর্কি
চারতলার ছাদে ছোট্ট দু’রুমের বাসায় আমরা তখন থাকি। মফস্বল শহরে এরকম উচ্চতার বাসা সংখ্যায় কমই থাকে। শুক্লপক্ষের রাতে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালে কৃষকায়া করতোয়া পেরিয়ে দূরের ঘুমন্ত গ্রামগুলোর কালচে শরীর চোখে পড়ে। রাত গভীর হলে নিশা মাঝে মধ্যে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। আমিও যাই কখনও কখনও। সে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। দূরের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে নিশ্চল; কথা বলে না। এরকম নির্বাক স্থবিরতায় কিসের শান্তি সে খুঁজে পায় জানি না।
সেদিন অফিস থেকে ফিরলাম রাত বারটার কিছু আগে। পেস্টিং- এর কাজটুকুও আমাকেই শেষ করে আসতে হয় নিয়মিত। নিশা আমার জন্যে টেবিলে ভাত সাজিয়ে রেখেছে। শোবার ঘরে গেলাম। নিশা নেই। বুঝলাম, কালো আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সে নিলাম্বরের স্বপ্ন দেখছে। ওর এই নিঃসঙ্গ পদচারণা আমার খারাপ লাগে না। ভাবি, অন্তত নিমগ্নতার শান্তিটুকু তো ওর জীবনে টিকে থাক। ভাত খেয়ে ছাদে গেলাম। নিশা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিশা আমার কপালে হাত দিল
─ তোমার শরীরটা কি এখন একটু ভাল লাগছে?
দুই বছর পত্রিকা অফিসে কাজ করছি। অবিরাম পরিশ্রম। নিয়মিত রাত জাগা। কখনও আমি অসুস্থতা বোধ করিনি। আমি অবশ্য সত্যি সত্যি বুঝি না শারীরিকভাবে আমি আসলে কতটা সুস্থ থাকি। নিশা মাঝে মাঝে প্যারাসিটামল বা ডিসপ্রিন জাতীয় ওষুধ খেতে দেয়। আমি খেয়ে ফেলি। আজও অফিসে যাবার সময় সেরকম একটা দায়িত্ব পালন করেছি এটুকু মনে আছে। বললাম
─ হ্যাঁ, এখন ভাল লাগছে।
নিশা চুপ করে রইল। নিচের রাস্তা দিয়ে নবাববাড়ি পেরিয়ে একটা রিক্সা জজ কোর্টের দিকে চলে গেল। এত রাতেও কিছু লোকের বিশ্রাম নেই। লাইট পোস্টের কাছে একটা চায়ের দোকান এখনও খোলা। ঘট ঘট শব্দ করে দোকানী চা বানাচ্ছে। ডায়াবেটিক হসপিটালের রোগীদের আত্মীয় স্বজন চা খায়। অস্থির হয়ে সিগারেট পান করে। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। আমার অনেক দোষ মেনে নিলেও এই দোষটা মেনে নিতে পারেনি নিশা। আমারও সিগারেট খেতে খারাপ লাগে─ অন্তত ওর সামনে। তবু মাঝে মাঝে উপেক্ষা না করে উপায় থাকে না। নিশা বলল
─ আচ্ছা বাবুল, তুমি কি সারাজীবন এ চাকরিটাই করে যাবে?
আমার চাকরি নিয়ে নিশার কোন অসন্তোষ আছে আগে জানতাম না। সে আমার সবগুলো লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। উপ-সম্পাদকীয়গুলো নিয়মিত কেটে রাখে। নিশা বলে, সাহিত্য না হলেও সংবাদ পরিবেশন কৌশলের মধ্যেও যে সৃষ্টিশীলতা থাকা সম্ভব তা নাকি আমার লেখা পড়লে বোঝা যায়। নিশার প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলাম। বললাম
─ কেন, আমার এ চাকরিটা তোমার ভাল লাগে না?
─ এরকম সারারাত জেগে তুমি কাজ কর এটা আমার আর ভাল লাগছে না।
─ আমি না জাগলে এ শহরের অন্য আর একজন মানুষকে তো এ কাজের জন্যে জাগতে হবে।
সে আমার সাথে তর্কে জড়াতে চাইল না। শুধু অস্ফুট স্বরে বলল
─ অন্য কেউ, সে তো অন্য কেউ-ই।
নিশা ঘরের মধ্যে চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। তারাভরা অনন্ত আকাশ। সীমাহীন নৈঃশব্দের সরোবর। কালপুরুষটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ঘরে ফিরে দেখলাম, নিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর একটা সিগারেট ধরালাম। দেয়াল ঘড়িটা আমাদের জীর্ণ ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ডেকে উঠল। মধ্যরাতের ঘোষণা দিল। ভাত খেয়ে আমি ডাইনিং টেবিলেই বসে রইলাম। আমার চারিদিকে শুধু জেগে আছে অবসন্ন আসবাব, প্লাস্টিকের একটা পানিশূন্য বোতল, বিস্কিটের টিন, ফিলিপস- এর একশ’ ওয়াটের একটা বাল্ব, দেয়ালে টানানো ‘দি লাস্ট সাপার’।

দরজা দিয়ে পাশের রুমে তাকিয়ে দেখলাম নিশা ঘুমোচ্ছে─ অসাঢ়, নিশ্চেতন। ঘুমিয়ে পড়লে ওকে খুব ক্লান্ত দেখায়। হয়তো এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবু আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি মাঝে মাঝে ওর কৈশোরের কথা ভাবি। হয়তো ভীষণ প্রাণময় ছিল সেই দিনগুলো। প্রায়ই আমি কল্পনায় একটা দৃশ্য দেখিঃ রংপুর পিডিবি কলোনির কংক্রিটের রাস্তা ধরে ফ্রক পরা এক উচ্ছল কিশোরী ছুটে যাচ্ছে...। ফ্রকটা টকটকে লাল। মাথার দু’পাশে শক্ত করে বাঁধা দুটো বেণী। কর্মচঞ্চল পৃথিবীর সাথে তার কোন যোগসূত্র নেই। ভাবি, তখন সে তো জানত না, গুড়ো দুধের টিন শূন্য হয়ে গেলে অপেক্ষমাণ অতিথির সামনে কতটা বিব্রত হতে হয়; মাসের কুড়ি তারিখ পার হয়ে গেলে দোকানীরা ক্রমশ নির্দয় হয়ে ওঠে। জানত না, সিঁড়ি ঘরের মাটির উনুনে দিনে দু’বার আম কাঠের আগুন জ্বালাতে কতটা কষ্ট হয়; আর দশ ফিট বাই দশ ফিট একটা ঘরে আকাঙ্ক্ষার বিশাল মহীরুহটা ডাল পালা গুটিয়ে বন্দী হয়ে পড়ে।
আগামীকালের সম্পাদকীয় না লিখে ঘুমোতে যাওয়া যাবে না। বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা আছে─ ‘উত্তরবঙ্গে পাট শিল্পের সমস্যা ও তার প্রতিকার’। অফিস থেকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত নিয়ে এসেছি। লেখা শেষ করতে ভোর হয়ে গেল। নিশার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরে সে বালিশে মুখ গুঁজল। আমি কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। ঘুম থেকে উঠলাম বারটায়। আলোকোজ্জ্বল দুপুর। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বৈদ্যুতিক তারে একটা বাদুড় ঝুলে আছে। বাদুড়টা কাল ছিল না। আজ রাতে প্রাণ দিয়েছে। বৈদ্যুতিক শক্তির সংহারি রূপ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। আমার জানালা থেকে বাদুড়টার দূরত্ব দশ ফিট। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া লক্ষ কোটি ঘটনার মধ্যে প্রানের সমাপ্তিও একটা ঘটনা; প্রকৃত অর্থে যার আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই; এমনকি যে প্রানের সমাপ্তি ঘটে তার কাছেও। কালই বাদুড়টার সচল রক্ত সংবহনতন্ত্র ছিল, ক্রিয়াশীল পাকস্থলি ছিল, মস্তিষ্কের নিউরোন সেলের সারিবদ্ধ তথ্য স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরে প্রবাহিত হতো, নিঃসীম আকাশ গাঙে বায়ুর বন্যায় সচল হয়ে উঠত দুটো পাখা। মুহূর্তের ভগ্নাংশে যতগুলো জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া ঐ ছোট্ট শরীরটাতে সম্পাদিত হতো পৃথিবীর সমস্ত যান্ত্রিক উদ্যোগের চেয়ে গুণগত উৎকর্ষে তা উন্নত। বাদুড়টা এখন একটা দোমড়ানো কাগজের মত প্রাণহীন। নিশা পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল
─ বাবুল।
─ বল।
─ চল না কিছুদিনের জন্যে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তোমার শরীরটা বেশি ভাল না। বিশ্রাম নেবে। তাছাড়া বাবা মাকেও কেন জানি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
খুব প্রয়োজন না হলে নিশা কোনো কিছুই দাবী করে না। আর সাধারণত নিজের থেকে বাড়ি যাবার কথা কখনই বলে না। আমি ভাল করেই জানি ছুটির আবেদন করে কোন লাভ হবে না। এসময় মঞ্জুর হবার কোন সম্ভবনা নেই। সহকারী বার্তা সম্পাদক ছুটিতে। সন্তোষ বাবু অন্য একটা দৈনিকে যোগ দিয়েছেন মাস খানেক হলো। কিশোর কাকলি পাতার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। এখন সে পাতাটাও আমি দেখছি। তাই ইতস্তত করে বললাম
─ নিশা, এ সময় ছুটি পেতে আমার সমস্যা হবে। মাস খানেক পরে গেলে হয় না ? দরকার হলে আমি একবারে দিন দশেকের ছুটি নিয়ে নেব।
নিশা কোন কথা বলল না। ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। সে কাঁদল না। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কাঁদলে নিশার সব দুঃখ শেষ হয়ে যায়। মুহূর্তে সে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কখনো কষ্ট পেয়ে না কাঁদলে কান্নাটা সে চেপে রাখে অনেকদিন। নিশা পাশের ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল। কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করল। জানালার পর্দাগুলো খুলে বালতিতে ভিজিয়ে রাখল। সবশেষে দু’কাপ চা তৈরি করে নিয়ে এসে টেবিলে বসল। এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিল আমার দিকে। নিমাকে লেখা একটা চিঠি। ওকে বাবার সাথে আসতে লিখেছে। ছোট বোনের জন্যে বিবাহিতা বড় বোনের যতটা দরদ থাকে আমার ধারণা নিমার জন্যে নিশার ভালবাসা তার থেকে কিছুটা বেশি। বয়সের পার্থক্য এক দশকের কম হলেও নিমাকে সে অনেকটা মেয়ের মত আদর করে। নিশা বলল
─ অফিসে যাবার সময় পোস্ট করে দিও।
চিঠিটা পকেটে রেখে দিলাম। অফিসে গেলাম বেশ দেরি করে। ডেস্কে অনেক কাজ জমে আছে। সম্পাদকের সই করা একটা চিরকুট টেবিলে রেখে গেছে কেউ। চোরাচালানের সংবাদটা তিনি চতুর্থ পৃষ্ঠায় ছাপার নির্দেশ জারি করেছেন। হেডিং হবে এক কলাম। সংশ্লিষ্ট কারো নাম লেখার দরকার নেই। এ ধরনের কাজ করতে প্রথম প্রথম আমার খুব খারাপ লাগত। এখন আর লাগে না। একধরনের মজাই পাই। সম্পাদকের নির্দেশ পেলে আমার কলমের এক আঁচরে এক লক্ষ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারি─ সে-ও কম কিসে! বরং যতটা শিল্পিত করে মিথ্যাকে উপস্থাপন করতে পারি ততখানি শান্তিই যেন পাই মনে মনে।
কাজে মন বসছিল না। বাড়ি যাবার ইচ্ছেটাকে নিশা দমন করল সংগোপনে। নিজেকে কিছুটা অপরাধী মনে হলো। সাতদিনের ছুটি চেয়ে সম্পাদক বরাবর একটা দরখাস্ত লিখলাম। একটু পরে তিনি ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন কেন আমি ছুটি চাচ্ছি। বললাম, ‘শুধু বিশ্রাম নেবার জন্যে’। আমার সাথে বন্ধুসুলভ হলেও সম্পাদক রোকন সাহেব বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। একজন দায়িত্বশীল সম্পাদকের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে আছে। সময় ও শ্রমের ব্যবহার বলতে যা বুঝায় তা তিনি নিজে করেন, অন্যকে দিয়েও করিয়ে নেন। তিনি আমাকে সাতদিনের রিক্রিয়েশন লিভ মঞ্জুর করলেন। তবে শর্ত হলো, এ সময়ের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের ওপর একটা ফিচার তৈরি করে আনতে হবে। চাইলে আমার মিসেসকেও সঙ্গে নিতে পারি। সব খরচ অফিস বহন করবে। নিশা কখনও সমুদ্রে যায়নি। আমাদের বিয়ের পরে বেশ কিছুদিন সে সমুদ্রের স্বপ্নে বিভোর ছিল। না দেখা সাগরের বিশালতার বিস্তার নিয়ে তার আগ্রহের সীমা ছিল না। সে প্রায়ই বলত
─ বাবুল আমরা কখনও সমুদ্রে যাব না?আমি হয়তো বলতাম
─ কিছুদিন অপেক্ষা কর; যাব।
সে অপেক্ষা করেছে অনেকদিন। এখন আর করে কিনা জানি না। হয়তো করে। হয়তো করে না: তার কল্পনার বেলাভূমি থেকে সাগরের দূরত্ব বেড়েছে হাজার মাইল। তবু সম্পাদক রোকন সাহেবের প্রস্তাবে মনে মনে আনন্দিত হলাম খুবই। ট্রেনের টিকেট নিয়ে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলাম। নিশাকে ডেকে বললাম
─ সাগর দেখতে যাবে?
নিশা অবোধ দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সব কিছু খুলে বললাম। তখনও তার দৃষ্টিতে অবিশ্বাসের ছায়া। মানিব্যাগ থেকে ট্রেনের টিকেট বের করে সামনে ধরলাম। নিশার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। নিশা কম কষ্টে কাঁদে আর বেশি আনন্দে কাঁদে। নিশা কি সত্যি সত্যি এতটা ভালবাসে সমুদ্রকে ? পরদিন ট্রেন, বাস, ট্রলার করে দিঘলদিয়া পৌঁছুতে বিকেল পেরিয়ে গেল। রোকন সাহেব একটা বিদেশী সংস্থার রেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্যে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। আমরা গিয়ে উঠলাম দোতলার একটা ডাবল বেডেড রুমে। মালপত্র গুছিয়ে রেখে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি দূর করতে নিশা ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যার পর আমরা রেস্ট হাউসের দক্ষিণ দিকের বরান্দায় চেয়ার নিয়ে বসলাম। বেয়ারা চা নিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খেতে চাই আমরা। আমি বললাম─ মাছ, যে কোন সবজি আর ডাল। নিশা কোন আপত্তি করল না। বারান্দা থেকে আমরা সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেঙে পড়া ঢেউয়ের মাথায় ছুটন্ত ধবল ফেনারাশির ওপর চাঁদের অনুজ্জ্বল আলো প্রতি মুহূর্তে চকমক করে উঠছিল। রাতের সমুদ্রটা আমার আরো কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছে করল। নিশা চেয়ারের পেছনের দু’পায়ে ভর করে ইজি চেয়ারের মত দোল খাচ্ছে। বললাম
─ সাগরপাড়ে যাবে ?
নিশা ‘হুঁ’ বলে আহলাদি ভঙ্গিতে মাথাটা কাত করে রাখল।আমরা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সাগর পাড়ে পৌঁছুলাম। তখন ভাটার সময়। আমি আর নিশা সিমেন্টের তৈরি একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। যতদূর দৃষ্টি যায় অপার্থিব এক ম্লান আলোর বন্যায় সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউগুলো সাঁতার কেটে ছুটে আসছে দিঘলদিয়ার জেলে পল্লীর দিকে: অনেকক্ষণ ধরে গমগম শব্দে ভেঙে পড়ছে আমাদের পায়ের কাছে। মনে মনে ভাবলাম, খুব অল্প সময় এ সমুদ্রের সান্নিধ্যে আমরা থাকব। যেভাবে নিশা এখন আমার কাছে আছে। এভাবে হয়তো আরও বছর কুড়ি থাকবে সে আমার কাছে। তারপর হয়তো একটা পরম গভীর অন্ধকার কিংবা একটা নিরুদ্দেশ বিস্মরন─ ডার্ক অবলিভিয়ন- আমাদের গ্রাস করবে। অথচ অনাদি অতীত থেকে অনন্ত আগামী পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের এ ক্রীড়ারাশি। এর শুধু ক্ষুদ্র একটা অংশ আমরা পেয়ে গেলাম যা পূর্ণতার সহস্র কোটি ভাগের এক ভাগও না। আমাদের পায়ে বড় একটা ঢেউ এসে ঝাপটা দিয়ে গেল। নিশা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বুকে মাথা রেখে পার করে দিল অনেকটা গভীর নিস্পন্দ সময়।
ভাবলাম, নিশার প্রতি অবিচার করা হয়ে গেছে। কলেজে পড়াকালীণ নিশা তার এক সহপাঠীকে পছন্দ করত। ছেলেটাকে আমি চিনতাম। নাম সাকিব। আমি তখন ওদের কলেজে পদার্থ বিদ্যার প্রভাষক। নিশা ছাড়া অন্য কারো সাথে তাকে কথা বলতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কোঁকড়া চুল, পুরু চশমায় ছেলেটাকে একটা খুদে বিজ্ঞানীর মতো দেখাতো। সে যখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন তার প্রথম বই ‘ইজ অব দ্য স্কাই’ প্রকাশ পায়। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বই। কিন্তু দর্শন, মনস্তত্ত্ব, পদার্থ বিজ্ঞান ও যুক্তি বিদ্যার এমন কিছু মৌলিক বিষয়ের সন্নিবেশ বইটাতে ছিল যা এক কথায় অসাধারণ।
নিশার হয়তো অনেক সাধ ছিল, সাকিবের হাত ধরে কোন একদিন এরকম কোন এক বেলাভূমিতে হাঁটবে। সে স্বপ্ন তার অপূর্ণ থেকে গেছে। এখনও সে হয়তো সাকিবকে ভালবাসে অনেক। তাই তার প্রতি ঈর্ষার একটা ক্ষুদ্র অংশ হয়তো আমি নিজের অজান্তেই নিশার উপর প্রয়োগ করেছি। বিয়ের কিছুদিন পর আমি একদিন নিশাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
─ নিশা, তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাস কাকে, শ্রদ্ধা কর কাকে?
─ তোমাকে।
─ তুমি সত্যি কথাটা বললে আমি কষ্ট পাব, কিন্তু জানব যে তুমি একজন সৎ মানুষ।
─ আমি সত্যি কথাটাই বলেছি।
─ এ অসততার জন্যেই সাকিব তোমাকে ছেড়ে গেছে।
─ আর এ অপ্রিয় কথাটা বলার জন্যে আমারও উচিৎ তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া।
এরপর থেকে নিশার মধ্যে আর কখনও রাগ, অভিমান, দুঃখ, ক্ষোভের তীব্রতা লক্ষ করিনি। তবে আমার মনে হয়েছে, আমার জন্যে তার ভালবাসা অটুট আছে বরাবরই। দিঘলদিয়ায় বেড়াতে এসে সেটা আরও ভাল করে বুঝলাম।.খুব ধীরে নিশা উঠে দাঁড়াল। একটু হেঁটে গিয়ে ঢেউয়ের ওপর দুই হাতে সজোরে আঘাত করে পানি ছিটিয়ে দিল শূন্যে। বিপুল উল্লাসে সে হাসতে শুরু করল। এ কি করছে নিশা! সে তো এমন শব্দ করে কখনও হাসে না! নিশা হেঁটে যাচ্ছে দক্ষিণে, যেখানে সমুদ্রের ঢাল আরো গভীর হয়েছে। আমি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চিৎকার করে ডাকলাম
─ নিশা আর দূরে যেয়ো না।
নিশা দ্রুত হেঁটে মহীসোপানের দিকে যাচেছ। আমি ছুটে গিয়ে তার পিছু নিলাম। ঢেউ ঠেলে বুক পর্যন্ত পানিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রাণপণ ডাকলাম, সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম
─ নিশা।
ততক্ষণে সমুদ্র কি এক ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ গর্জনে জেগে উঠেছে। আমার ডাক নিশা শুনল না। সমুদ্রের কলহাস্য কিংবা মায়াবী কান্নার ডাক শুনল সে। জোয়ারের জল বাড়ছে; বিপরীতমুখী স্রোতের শক্তি বাড়ছে। আমি বেলাভূমিতে এসে দাঁড়ালাম। নির্জন বেলাভূমি। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। মধ্যরাত পেরোলে আমি সাগর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। তারাভরা অনন্ত আকাশ। সীমাহীন নৈঃশব্দের সরোবর। দেখলাম, কালপুরুষটা ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে।
হাসান গোর্কি
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া
hassangorkii@yahoo.com
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন
গল্পঃ সাম্রাজ্য – হাসান গোর্কি
প্রবন্ধঃ রোহিঙ্গা সঙ্কটঃ বাংলাদেশের ভূমিকা কি সুচিন্তিত – হাসান গোর্কি
-
গল্প//উপন্যাস
-
13-09-2017
-
-