অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
নীহারিকা - কিরণময় নন্দী

তুমি আজ বহু যোজন দূরে আমার ঠিকানা হতে।
আমেরিকায়। শুনেছি তোমার ওখানে খুব ঠান্ডা অনিরুদ্ধ। ফায়ার প্লেসের উষ্ণতায় হয়তো ভীষণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছো। নয়তো লেট নাইট পার্টি সেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ির পথে। 
কি জানি! এই সাতসকালের অজ পাড়াগাঁয়ের এক মেয়ের মৃত্যুসংবাদ তোমার ওখানে পৌঁছবে কি না!
জানো অনিরুদ্ধ তোমার নীহারিকা মরে গেছে।বিদায় নিয়েছে এই মেকি দুনিয়া থেকে। নোংরা মানসিকতার পৃথিবী থেকে। বিশ্বাসঘাতকতার বধ্যভূমি থেকে।
বহু প্রতীক্ষার অবসান হলো অনিরুদ্ধ। আর কেউ তোমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করবে না। 
স্নাতকের পাঠ সেরে বাড়িতে বসে আছি প্রায় সাত বছর। কয়েকটা টিউশানি নিয়ে সময় কাটানো।গান শোনা। মোবাইলে সময় কাটানো। কবিতা পড়া আর শুধু তোমার অপেক্ষা। 
দেখাশোনা হয়নি তা নয়।পাত্রপক্ষ নিয়ম মেনে পক্ষকাল পরপর এসেছে। কারও পছন্দ হয়েছে কারও হয়নি। কিন্তু আমি অবিচল। তোমার প্রতীক্ষায় অবিচল। তারপর পাত্রপক্ষ আসা কমতে শুরু করলো। মা-বাবা নিরুপায় হয়ে বন্ধ করলেন এই আয়োজন।
জানো অনিরুদ্ধ মনে পড়ে ভিক্টরিয়ার সবুজ ঘাসে মুখোমুখি বসে তুমি আর আমি। পাশাপাশি কত যুগলের গভীর প্রেম বিনিময়। আর আমরা ভীষণ শান্ত-নিশ্চুপ। মনে পড়ে অনিরুদ্ধ একসাথে আইসক্রিম খাওয়া। তুমি তো ঠান্ডার ভয়ে পুরোটা খেলেই না। 
জানো আজ আমি দুপুরের পর থেকে শহরের নামি মর্গের ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা সংরক্ষিত কক্ষে। জানো আমার আর নাম নেই। আমার কপালে একটা নাম্বার সাঁটা। ওটাই আমার পরিচয়।

আমায় তুমি ক্ষমা করো অনিরুদ্ধ। আর কতো অপেক্ষা করবো বলো। তোমার মাস্টার্স। তোমার ডক্টরেট।তোমার পোস্ট ডক। আর কত? 
তারপর তোমার বিয়ে! তুমি আমায় ভুলে গেলে অনিরুদ্ধ?
এক নীল সালোয়ারে হাসিখুশি নীহারিকার কথা। যে তোমার অন্তঃকরণের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে বারবার ছুটে বেড়াতো। কলেজ ফেরা যে নীহারিকার ক্লান্ত ওষ্ঠে গোপনে এঁকে দিয়েছিলে নিকোটিনের গন্ধ মেশানো উষ্ণ ওষ্ঠের চুম্বন। স্বপ্ন দেখিয়ে যার অনাবৃত শীতল কাঞ্চনজঙ্ঘায় এনছিলে উষ্ণ মরুভূমির উষ্ণতা... তাকে তুমি ভুলে গেলে অনিরুদ্ধ। 
আর কয়েকঘণ্টা পর বার্নিং ঘাটে শত শত ডিগ্রি সেলসিয়াসে মাত্র একঘন্টায় ছাই হয়ে যাবে আমার শরীর। আর তুমি হয়তো বিদেশী বউয়ের শরীরে এঁকে দেবে ভালোবাসার ক্ষতচিহ্ন। 
নীলরঙা গাউন দেখে মনে পড়বে পলাশপুরের নীহারিকাকে! কোনো অবসরে বাংলাগানের মেলোডিতে খুঁজে পাবে তোমার নীহারিকাকে!কোনোদিন তোমার গাঁয়ে ফিরে এলে ওই নদীর তীরে বসলে উপলব্ধি করতে পারবে তোমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব-কৈশোর-যৌবনের কিছু স্মৃতি আর তোমার নীহারিকাকে।
তুমি ভালো থেকো অনিরুদ্ধ। ভীষণ ভালো থেকো। স্বপ্নপূরণের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাও তুমি। স্বপ্ন ভাঙা নীহারিকা হয়তো তোমার জীবন গন্তব্যের এক ক্ষুদ্র স্টেশন। তোমার নিরন্তর গতির সাময়িক স্থিতিশীলতা।

কিরণময় নন্দী
পাতুল,খানাকুল,হুগলী