অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
টোবারমরি: অপসৃত হিমবাহের বিরল স্মৃতিচিহ্ন - সাইফুল ভুইয়া

বাংলাদেশে বসন্ত আর গ্রীষ্ম এক না। কানাডায় যদিও গ্রীষ্ম আর বসন্ত মিলে মিশে একাকার – অনেকটা জামাত বিএনপির মতো।

     এখানে ভ্রমণ আর আনন্দের সময় মানেই গ্রীষ্মকাল। ভাবছি এই গ্রীষ্মে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়? সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঠিক হলো সবাই মিলে যাবো টোবারমরিতে। আমার একার চেয়ে বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে বেশী ভালো লাগে। ঠিক হলো আমরা চার ফ্যামিলি মিলে ভ্রমণে যাবো। যথারীতি সবার জন্য কটেজ এবং জাহাজে বুকিং দেয়া হলো। হৈ হৈ রৈ রৈ - যাত্রা হলো শুরু। উইন্ডসর থেকে টোবারমরি, স্ব-দলবলে আনন্দ ভ্রমণ। 
     তিনটি গাড়ি পর পর- আটাশে আগস্ট শুক্রবার সকাল থেকে নিরন্তর ছুটে চলা। আমরা চলেছি লেক হিউরনের গা ঘেঁষে। গন্তব্য ব্রুস পেনিনসূলার লায়ন্সহেড শহর। পথে একাধিকবার যাত্রা বিরতি দিয়ে আমরা দিনান্তে পৌছে গেলাম ব্লু-ওয়াটার সিটি লায়ন্সহেডে। এটি জর্জিয়ান উপসাগরের পাড়ে অবস্থিত একটি খুব সুন্দর পর্যটন শহর। আমরা কটেজ নিয়েছি এখানেই। আমাদের কটেজের ঠিক পেছনেই এখানকার মূল আকর্ষণ লায়ন্সহেড মেরিনা। খুব সুন্দর এবং গোছানো এই পোতাশ্রয়টি থেকে দক্ষিণে তাকালে মনে হয় লেকের পাড়ে একটি জীবন্ত সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ঊচিয়ে সটান তাকিয়ে আছে সি-বিচের লোকগুলোর দিকে। হয়ত এজন্যই এই শহরের নাম হয়েছে লায়ন্সহেড। 
     সারা বিকেল সী-বিচে হাঁটাহাঁটি, নীলাভ স্বচ্ছ সলিলে জলকেলি- সবাইকে বেশ পুলকিত করেছে। সারাদিন ড্রাইভিং এর সব ক্লান্তি এখন শেষ। সবাই রওনা হলাম ট্রেইল ধরে লায়ন্সহেড ক্লিফে। শুরু হলো গাড় সবুজ পাইন বনের ভিতর দিয়ে অবিরাম পথ-চলা। কিন্তু আমাদের পথচলায় বাঁধ সাধল গোধূলি লগ্নের রক্তিম আভা। একটু পরেই এই পাইন বনে হয়তো নামবে গাঢ় অন্ধকার। তাই কাল ভোরের জন্য প্ল্যান রেখে সবাই ফিরলাম কটেজে- যেখানে রয়েছে অন্যরকম এক নৈসর্গিক পরিবেশ। 
     চারদিক বিশালকায় বৃক্ষ আর ঘন বন দিয়ে ঢাকা একটি বাড়ি। সামনেই ছোট্ট একটি কুয়া আর তাতে রয়েছে হলদে রঙের জলপদ্ম। বাড়ির আশে পাশে কোন লাইট নেই, আছে শুধু জোনাকির মেলা। সাথে যুক্ত হয়েছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যঙ্গের ডাক। বাসায় মেয়েরা এখন রান্নায় ব্যস্ত, কেউ বানাচ্ছে ডাল-পুরী আবার কেউবা রাতের খাবার নান-মাংস আর ভুনা-খিচুড়ি। হাল্কা শীতের এই চাঁদ রাতে আমি আর মিল্টন ভাই বাইরে পানসি ঘরে বসে আছি, উপভোগ করছি রাতের নির্জনতা । উনি এখন অনেকটা সৌখিন স্মোকার - তাই ফুঁকছেন গরম হাওয়া, আমি খাচ্ছি চাঁদের নরম আলো।
আজ শনিবার সকাল, একটা শিশির ভেজা হিমেল সকাল।

  ফ্লাওয়ার পট আইল্যান্ড, টোবারমড়ি  ছবিঃ নিগার শাহীন
     আগস্টের শেষের দিক। তাই দেখতে মনে হয় অনেকটা আমাদের দেশের হেমন্তের সকাল। খুব ভোরে আমাদের কেউ কেউ লায়ন্সহেড থেকে সূর্যোদয় দেখে বাসায় ফিরেছে। জর্জিয়ান উপ সাগরের তীরে দন্ডায়মান দেড় হাজার ফুট উঁচু ক্লিফ থেকে গাঢ় নীল কিংবা ফিরোজা রঙের পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে কেমন লাগে, শুনছিলাম সেই অভিজ্ঞতার কথা। নাস্তা খেতে খেতেই শুনছি মজার মজার সব গল্প। নাস্তায় কি নেই – রুটি পাউরুটি কলা ডিম মাখন জেলি এবং হটডগ সহ সব বাহারি খাবারের মেলা। প্রতি বেলায় ভিন্ন ভিন্ন জনের খাবারের দায়িত্ব থাকায় মেয়েদের ভিতর কাজ করেছে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। আয়োজন দেখে মনে হয় বেড়াতে নয় বরং পার্টিতে এসেছি।
এই মধ্যেই নাস্তার পর সবার চা পর্ব শেষ হয়েছে।
     এখন দেখার পালা এই উপদ্বীপের মূল আকর্ষণ ব্রুস পেনিনসূলা ন্যশনাল পার্ক এবং উপদ্বীপ মোহনা। ব্রুস উপদ্বীপের উত্তরাংশের পূর্ব উপকুলের একশত ছাপ্পান্ন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরী হয়েছে ন্যশনাল পার্ক। এটি নায়েগ্রা খড়গ পর্বতমালার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব জীব বৈচিত্র ভাণ্ডারের অন্যতম একটি। এই অঞ্চলের পর্বত বেষ্টনিতে রয়েছে অযুত-নিযুত বছরের পুরানো শীলা পাথর এবং সেই সময়কার জীব বৈচিত্রের নমুনা চিহ্ন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে আজ থেকে চারশ মিলিয়ন বছর আগে এই অঞ্চল ছিল অগভীর সমুদ্রের অংশ বিশেষ যেখানে ছিল বহু উদ্ভিদ এবং কোরাল জাতীয় জলজ প্রাণীর সমাহার। ক্রমে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানি শুকিয়ে সমুদ্র উচ্চতা নেমে যায় আর আবির্ভূত হতে থাকে নতুন স্থল ভাগ। সমুদ্র বক্ষে নিমজ্জিত চুনাপাথর বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ এবং ম্যাগনেসিয়াম শুষে নিয়ে অতি মাত্রায় ঘনিভূত হয় আর সৃষ্টি করে বিশেষ ধরনের কঠিন শীলা ডলোমাইট। আর আজকের দিনে এই সমগ্র নায়েগ্রা এস্কার্পমেন্ট জুড়েই দেখা যার ডলোমাইটে তৈরী খাঁড়া পর্বত-শ্রেনী। মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে পৃথিবী বদলেছে অনেক। তবে প্রমাণ মিলেছে যে সর্বশেষ বরফযুগের অব্যহিত পরেই এই উপদ্বীপটি বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। অমারা যাচ্ছি সেই সব অজানা রহস্যের সন্ধানে। প্রথমে যাব টোবারমরি- যা কটেজ থেকে মাত্র আধ ঘন্টার ড্রাইভ।
     এই পেনিনসূলার উত্তরে সর্বশেষ শহর হচ্ছে টোবারমরি। অবশ্য একে বলা যায় এই উপদ্বীপের টিপ অথবা মোহনা। টোবারমরি থেকে ছেড়ে যায় বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক নৌযান, যাদের গন্তব্য ফ্লাওয়ারপট আইল্যন্ড, ফেতম ফাইভ মেরিন পার্ক এবং কোভ আইল্যান্ড। আমরা চার ফ্যামিলি মিলে ছোট বড় চৌদ্দ জনের একটি নাতিদীর্ঘ গ্রুপ আজ সারাদিন ঘুরেছি প্যাকেজ ট্যুরে। সকাল দশটায় আমরা সবাই উঠি “ব্লু-হিউরন” নামের একটি কাচের তলা-যুক্ত জাহাজে। এটি আমাদের প্রথমে নিয়ে যায় ফেতম ফাইভ মেরিন পার্কে। আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগে লেক হিউরনে ডুবে যাওয়া বেশ কিছু জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম এই মেরিন পার্কে। অবাক ব্যপার হলো লেকের পানি এটি স্বচ্ছ যে তিরিশ ফুট পানির নিচে ডুবে থাকা এই সব ভগ্ন-জাহাজ আমরা খালি চোখে স্পস্ট দেখতে পেলাম। আরও দেখলাম নানা প্রজাতির বর্ণিল মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণী। মেরিন পার্ক ঘুরে আমাদের জাহাজ আমাদের নিয়ে গেল বহু প্রতীক্ষিত বিস্ময়কর সেই দ্বীপ ফ্লাওয়ার পট আইল্যন্ডে। এখানে আমরা কাটালাম দিনের অধিকাংশ সময়।

ফ্লাওয়ার-পট আইল্যন্ড
     যে দ্বীপের নাম শুনলেই কৌতূহলী হতে হয়, যার নামের সাথে জড়িয়ে আছে পাঁচ হাজার বছর আগের অপসৃত হিমবাহের উৎকীর্ণ জলরাশির গল্প- আজ দিনমাণ ঘুরেছি সেই দ্বীপে। শিলা কাকির্ন এই দ্বীপের পাদদেশে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছে ফুলের টব সদৃশ্য একাধিক উঁচু স্তম্ভ, দেখলে মনে হয় কোন নিঁপুণ কারিগর পাথরে খচিত ইটের গাঁথুনিতে তৈরী করেছে। আর এজন্যই হয়তো এর নাম হয়েছে ফ্লাওয়ারপট আইল্যন্ড- যার বাংলা নাম হতে পারতো “ফুলদানী দ্বীপ”। ক্যানাডার উইন্ডসর শহর থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব কোণে এবং টরন্টো শহর থেকে সোয়া তিনশ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত অনিন্দ সুন্দর এই দ্বীপ। টবারমরি উপকুল থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার উত্তরে জর্জিয়ান উপসাগরে অবস্থিত তিন বর্গকিলোমিটারের এই ছোট্ট দ্বীপটি শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য পরিভ্রমণ, হাইকিং এবং ক্যম্পিং এর জন্যই উম্মুক্ত। পুরো দ্বীপটি একবার চক্কর দিতে সময় লাগে দেড় ঘন্টা কিন্তু বাস্তবে দ্বিগুন সময় লাগে ঘুরতে, দেখতে এবং ছবি তুলতে। শীলা পাথরের পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় নেমে যেতে হয় পাহারের পাদদেশের ফ্লাওয়ার পটের নীচে, যেখানে স্ফটিক সচ্ছ জলে কেলি করে নানা রঙের পাখ-পাখালির দল। আদর পেলে এই পাখিরা মানুষের হাতে বসতেও দ্বিধা করে না। কোন এক সময় এই দ্বীপে তিনটি ফ্লাওয়ার পট ছিল। তবে সময়ের বিবর্তনে একটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো দুটো অবিকৃত অবস্থায় আছে। ধারণা করা হয় লেকের ঢেউ এবং পানির আঘাতের ফলে দ্বীপ সংলগ্ন তীরবর্তী অংশের নরম মাটি সড়ে গিয়ে হাজার হাজার বছর সময় নিয়ে তৈরী হয় এই ফ্লাওয়ার টবগুলো। বিস্ময়ের ব্যাপার এতো কঠিন শীলা পাথর দিয়ে তৈরি এই পট গুলোতে হাতুড়ি পিটিয়ে একটি বিনারী বসানো না গেলেও এতে জন্মেছে শত বছরের পুরানো বনসাই ধরনের পাইন গাছ। শিকড় দিয়ে উচ্চ মাত্রার ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ ডলোমাইট পাথর আঁকড়ে ধরে এরা বেঁচে আছে জনম জনম।
     এখন দিন গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল। আমাদের জাহাজ সবাইকে নিয়ে ফিরেছে টোবারমরিতে। ক্ষুধায় সবার প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি। সবাই খেতে বসলাম একটি লোকাল ফিস এন্ড চিপস রেস্টুরেন্টে। হোয়াইট ফিস আর ফ্রেন্স ফ্রাই সাথে বর্ণিল সব সস এদের খাবারের প্রধান বিশেষত্ব। সবাই খেল গোগ্রাসে কারণ বাড়তি হোয়াইট ফিসের ফ্রাই খেতে এখানে আর ডলার গুনতে হয় না। অনেকটা বাংলাদেশের ফেরি ঘাটের ডাল ফ্রি এর মতো। আমাদের এরপরের যাত্রা হবে ব্রুস পেনিন্সুলা ন্যাশনাল পার্ক এবং গ্রোটো।
     বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়ের - জীবন্ত কিছু শৈল্পিক নিদর্শন রয়েছে এই ন্যাশনাল পার্কে আজ থেকে সাড়ে চারশ মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট সাড়ে সাতশ কিলোমিটার দীর্ঘ নায়েগ্রা খড়গ পর্বতমালার একাংশ এই পার্ক। ব্রুস উপদ্বীপ লেক হিউরনের বুক চিরে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে প্রায় একশ বিশ কিলোমিটার এবং এটিই লেক হিউরন আর জর্জিয়ান উপসাগরের মধ্যে সীমানা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে যখন সর্বশেষ নিকটবর্তী বরফযুগের সমাপ্তি ঘটে ঠিক তখনই সৃষ্টি হয় এই উপদ্বীপের। ভূ-বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে নিকটবর্তি সর্বশেষ বরফ যুগে এই অঞ্চল ছিল বিশাল বরফে ঢাকা। পরবর্তীতে বরফ যুগ শেষ হলে সাড়ে তিন কিলোমিটার উচ্চতার এই বিশাল বরফস্তুপ পশ্চাদপসরন করে এবং সমস্ত নরম পাথর ও মাটি ধুয়ে নিয়ে পতিত হয় গ্রেট লেইকের জলবক্ষে। শুধু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে ডলোমাইট দিয়ে তৈরী কঠিন শীলার নায়েগ্রা এস্কার্পমেন্ট এবং বদ্বীপ সদৃশ্য এই উপদ্বীপ। কালের বিবর্তনে এখানে জমেছে ধূলার আস্তরণ, জন্মেছে সবুজ বৃক্ষরাজি, আর সমাগম ঘটেছে বহু বিরল প্রজাতির জীব বৈচিত্রের। আর এসবের বিরল কিছু স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে তৈরি হয়েছে এই ব্রুস পেনিনসুলা জাতীয় উদ্যান । 

ইন্ডিয়ান হেড কোভ এবং গ্রোটো
     টোবারমরি থেকে মাত্র বিশ মিনিট গাড়ী চালিয়ে আমরা এসেছি ব্রুস পেনিন্সুলা ন্যশনাল পার্কে। গহীন অরণ্যের বেশ খানিকাটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি পার্কের অফিসে এবং তারপর টিকেট নিয়ে এলাম পার্কিং এ। তারপর স্ব দলবলে প্রায় আধঘণ্টা হাইকিং করে আমরা পৌছালাম অন্য এক ভুবনে। এ যেন এক অচেনা ভুবন, অন্টারিও কিংবা ক্যানাডার কোন জায়গা নয়, বরং মনে হয় ক্যারাবিয়নে এসেছি। খাড়া পাহাড় থেকে সারে বারশ ফুট নিচে গাঢ় নীল কিংবা ফিরোজা রঙের পানি দৃশ্যমান হয়। আমরা ছোট বড় সবাই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেলাম একটি অদ্ভুত সুন্দর খাড়িতে। চারিদিক বেশ উঁচু পাহাড়ে ঘেরা আর মাঝখানে বিশাল এলাকা জুড়ে এই উপবৃত্তাকার খাড়ি। এটিকে বলা যায় একটি বিশাল আকারের প্রাকৃতিক সুইমিং পুল। এক বিন্দু ময়লা নেই কোথাও, পানি খুবই স্বচ্ছ এনং নীল, তবে হিম-শীতল। তবে উপসাগরের মিঠা জলে জলকেলির লোভ সামলাতে পারলাম না আমরা কেউই। প্রথমে মিল্টন ভাই, তারপর ইভান এরপর ছেলে মেয়ে সবাই নেমেছে পানিতে। ঠান্ডার ভয়ে শুধু বাকি থাকলাম আমি। কিন্তু উপায় নেই শেষটায় নামতে হলো আমাকেও। আর নেমেই দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড এক সাঁতারে চলে গেলাম বিশ গজ দূরে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল ফিরতে, ঠান্ডায় প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। তাও কোন আওয়াজ করলাম না, কোন ভাবে নিজের মান সম্মান নিজেই রাখলাম। কিন্তু সমস্যা হলো শাহীনের বেলায় – আর একটু থাকলে হয়ত সলিল সমাধি হতো। ভাগ্যিস সবাই বুঝতে পেড়ে টানাটানি করে পাড়ে এনেছিল। পরে যদিও ভয়ে আমাদের কেউ কেউ আর সাঁতারই দেয়নি।

   ইন্ডিয়ান কোভ এন্ড গ্রেটো   ছবিঃ স্বপ্নিল ভূইয়া
     এই খাড়ি থেকে একটু দূরেই ছিল গ্রোটো (গুহা)। আমাদের গ্রুপের তরুণ সদস্যদের প্রায় সবাই গিয়েছে সেই নিমজ্জমান জল গুহায়। জর্জিয়ান উপসাগরের কোন এক পরাক্রমশালী ঢেউয়ের আঘাতে হয়তো তৈরি হয়েছিল বিস্ময়কর এই গ্রোটো। উপরে শীলা পাথরের আচ্ছাদন আর নিচে জর্জিয়ান উপসাগরের মিঠা পানি। জল, স্থল আর শীলা পাহাড়ের এই অপূর্ব মিলন মেলা, না দেখলে অনুধাবন করা সত্যিই দূরহ ব্যাপার।
     ইন্ডিয়ান কোভ আর গ্রোটোর দুঃসাহসী অভিযান শেষে আমরা এখন কিছুটা ক্লান্ত। তবে উপায় নেই আধা ঘন্টারও বেশি সময় আমাদেরকে হাইকিং করতে হলো নিগুঢ় অরণ্যের মধ্য দিয়ে অনেকটা অন্ধকার পথে। কেউ কেউ সেল ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সাহস সঞ্চয় করেছে আবার কেঊবা দোয়া দূরুদের জোরে হাঁটছে। তবে শেষ পর্যন্ত গাড়িতে পৌঁছাল ঠিকই।
 প্রায় চল্লিশ কোটি বছর আগে সৃষ্ট শিলা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কৌতূহলী এই গাংচিল।   ছবিঃ সাইফুল ভূইয়া
এবার ফেরার পালা।
পর পর আমাদের তিনটি গাড়ি ছুটে চলেছে লায়ন্স হেডের উদ্দ্যেশে। লেকের প্রভাবে মাঝে মাঝেই পথে নামছে ঘন কুয়াশার আচ্ছাদন। তবে একটু আগের নিকশ কালো অন্ধকার এখন আর নেই। আকাশে উঁকি দিয়েছে ভরাট চাঁদ, গাড়ীতে বাজছে হুমায়ুন আহমেদের সেই বিখ্যাত গান 
“চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়”। 
না মৃত্যু নয়, আমরা বেঁচে থাকতে চাই আরো অনেক দিন। 
উপভোগ করতে চাই সৃষ্টির অপার লীলা।

সাইফুল ভুইয়া
উইন্ডসর, কানাডা